‘ওঁ’ (সংস্কৃত: ॐ) শব্দটি হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন, পবিত্র ও গভীর অর্থবহ মন্ত্র। এটি শুধু একটি শব্দ নয়, বরং এক মহাশক্তির প্রতীক, যা সৃষ্টির আদিধ্বনি হিসেবে বিবেচিত হয়। হিন্দু দর্শন মতে, ‘ওঁ’ শব্দটি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ব্রহ্মাণ্ড, জীবজগৎ এবং সকল সত্তার চেতনা। তাই এটি ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও মনোবৈজ্ঞানিকভাবে এক অপার গুরুত্ব বহন করে।
আজকের বিজ্ঞান যেখানে ইউনিভার্সের ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পন খুঁজছে, হাজার হাজার বছর আগে আমাদের ঋষি-মুনিরা ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অনুভব করেছিলেন এই ‘ওঁ’ ধ্বনির অলৌকিকতা। এটি শুধু শোনার জন্য নয়, উপলব্ধি করার জন্য — আত্মশুদ্ধি ও পরমসত্যের পথে অগ্রসর হওয়ার এক শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
‘ওঁ’ মন্ত্র কী? – ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ
‘ওঁ’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষার একটি মন্ত্র, যাকে প্রণব মন্ত্র (Pranava Mantra) বলা হয়। এটি তিনটি ধ্বনির সংমিশ্রণে গঠিত – ‘অ’ (A), ‘উ’ (U), এবং ‘ম’ (M)। এই তিনটি ধ্বনি একত্রে উচ্চারণ করলে “ওঁ” ধ্বনি সৃষ্টি হয়। প্রতিটি ধ্বনির রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক তাৎপর্য:
- ‘অ’ (A) – প্রতীক সৃষ্টির (Brahma): জীবনের শুরু, জগতের উদ্ভব, প্রথম নিঃশ্বাস।
- ‘উ’ (U) – প্রতীক রক্ষার (Vishnu): প্রাণের প্রবাহ, স্থিতি, ধারাবাহিকতা।
- ‘ম’ (M) – প্রতীক বিনাশের (Maheshwar/Shiva): চক্রের সমাপ্তি, ধ্বংস ও পুনর্জন্মের সূচনা।
এই ধ্বনিগুলোর সম্মিলন প্রকাশ করে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের চক্র — যা সনাতন দর্শনের মূল ভিত্তি। এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, ‘ওঁ’ মন্ত্র শুধু কোনো নাম বা শব্দ নয়; এটি একটি চেতনার রূপ, যা সর্বত্র বিদ্যমান।
শাস্ত্রমতে, ‘ওঁ’ হচ্ছে ব্রহ্ম – সর্বজ্ঞান, সর্বব্যাপ্ত, নিরাকার পরম সত্যের ধ্বনি-রূপ প্রকাশ। তাই বলা হয়, “ওঁ ইত্যাদিনাম ব্রহ্মণঃ স্বরূপম্” — অর্থাৎ ‘ওঁ’ হল ব্রহ্মের স্বরূপ।
‘অ’, ‘উ’ ও ‘ম’ – তিনটি ধ্বনির গভীর অর্থ
‘ওঁ’ মন্ত্রের মূলে রয়েছে তিনটি মৌলিক ধ্বনি — ‘অ’ (A), ‘উ’ (U) এবং ‘ম’ (M)। এগুলো শুধু ধ্বনি নয়, বরং একটি গভীর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ বহন করে। এই তিনটি ধ্বনি মিলে সৃষ্টি করে এক পূর্ণ চেতনার প্রবাহ, যা জীবনের সব দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।
🅰️ ১. ‘অ’ (A): সৃষ্টির প্রতীক
এই ধ্বনিটি সব কিছুর শুরু বা উৎপত্তিকে বোঝায়। এটি প্রতীক:
- ব্রহ্মা (সৃষ্টি কর্তা দেবতা)
- জীবনের সূচনা, প্রথম নিঃশ্বাস
- জ্ঞান, আলো ও সম্ভাবনার প্রকাশ
যখন কেউ “অ” উচ্চারণ করে, তা গলার নিচ থেকে শুরু হয় — অর্থাৎ জীবনশক্তির উৎস।
🔤 ২. ‘উ’ (U): স্থিতির প্রতীক
এই ধ্বনিটি প্রতিনিধিত্ব করে:
- বিষ্ণু (রক্ষাকর্তা)
- স্থিতি, ভারসাম্য, রক্ষণশীলতা
- জীবনের মাঝের পর্যায়, যেখানে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা গঠিত হয়
“উ” ধ্বনি মুখগহ্বরের মাঝখানে প্রতিধ্বনিত হয়, বোঝায় চলমান চেতনার অবস্থা।
〽️ ৩. ‘ম’ (M): লয়ের প্রতীক
এই ধ্বনি বোঝায়:
- শিব (বিনাশ ও রূপান্তরের দেবতা)
- শেষ, বিশ্রাম, পুনর্জন্মের সূচনা
- ধ্যান ও চেতনার নিস্তব্ধ অবস্থা
“ম” ধ্বনি ঠোঁট বন্ধ করে উচ্চারণ করলে তা সম্পূর্ণ এক গভীর নিরবতা তৈরি করে — যা চূড়ান্ত ধ্যান বা সমাধির চিহ্ন।
এই তিনটি ধ্বনি একসাথে শুধু ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি চক্রকেই বোঝায় না, বরং মানবজীবনের পূর্ণ আবর্তন — জন্ম, জীবন ও মৃত্যু — তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রকাশ করে। তাই ‘ওঁ’ মন্ত্র উচ্চারণ মানে একরকমভাবে পুরো অস্তিত্বকে অনুভব করা।
ওঁ মন্ত্র ও সৃষ্টির সম্পর্ক (ব্রহ্মাণ্ডের মূল ধ্বনি)
হিন্দু দর্শনে বিশ্বাস করা হয়, ওঁ হল সৃষ্টির প্রথম ধ্বনি — ব্রহ্মাণ্ডের জন্মলগ্নে যে কম্পন বা শব্দ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটিই “ওঁ”। এটি কোনও কল্পনা নয়, বরং আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও সাধনার মাধ্যমে উপলব্ধ সত্য। এই ধ্বনি শুধু শব্দ নয়, এটি এক চেতনা — এক বিশ্বজনীন কম্পন (Universal Vibration), যা সর্বত্র বিরাজমান।
🌌 উপনিষদের ভাষ্যে:
“ওঁ ইত্যেতদক্ষরং ইদং সর্বং” (মাণ্ডুক্য উপনিষদ)
👉 অর্থ: ‘ওঁ’ এই একমাত্র অক্ষরই সব কিছু।
এখানে বোঝানো হয়েছে, ওঁ-তে নিহিত আছে সমগ্র সৃষ্টির বীজ। এই ধ্বনির মধ্যেই আছে সময়, স্থান ও অস্তিত্বের সকল স্তরের প্রতিফলন।
🌠 আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে:
বিজ্ঞান বলে, মহাবিস্ফোরণ থেকেই এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। সেই বিস্ফোরণের পর প্রথম যে তরঙ্গ বা কম্পন-ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটি অনেক গবেষকের মতে একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল। অনেক সাধক ও ধ্যানাচার্য মনে করেন, ওঁ ধ্বনির কম্পন সেই আদিধ্বনিরই প্রতিবিম্ব।
🔊 ধ্বনির শক্তি:
ওঁ মন্ত্র উচ্চারণ করলে আমাদের শরীর ও পরিবেশে যে কম্পন তৈরি হয় তা শুধু মনকে শান্তই করে না, বরং এক গভীর সৃষ্টি-শক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এই ধ্বনি যেন এক অদৃশ্য সেতু — আত্মার সঙ্গে বিশ্বচেতনার সংযোগ।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, ‘ওঁ’ শুধু এক ধ্বনি নয়, এটি হলো সৃষ্টি, চেতনা ও কালের আদিঅস্তিত্বের অনুরণন। এটি এমন এক শব্দ, যা ব্রহ্ম (সর্বশক্তিমান ঈশ্বর)-এর সরাসরি প্রকাশ। তাই প্রতিটি ধর্মীয় আচারে, মন্ত্রে, ধ্যানে ‘ওঁ’ ধ্বনির মাধ্যমে শুরু করা হয় — কারণ এটি শুরু নয়, শুরুতেও যিনি আছেন তাঁর প্রতীক।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে ‘ওঁ’-এর উল্লেখ (উপনিষদ, গীতা, বেদ)
‘ওঁ’ মন্ত্রটি হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থসমূহে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত। এটি শুধু একটি শব্দ নয়, বরং এক মহাশক্তির চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত — যা সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বশক্তিমানের প্রতীক।
📘 🌿 বেদে ‘ওঁ’-এর উল্লেখ:
- ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ — এই চারটি মূল বেদেই ‘ওঁ’-কে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
- ‘ওঁ’ ধ্বনিকে বলা হয়েছে “উচ্চারণযোগ্য ব্রহ্ম” — অর্থাৎ শব্দরূপে ঈশ্বর।
- যজ্ঞ, স্তোত্র, প্রার্থনা — সবকিছুর শুরুতে ‘ওঁ’ উচ্চারণ বাধ্যতামূলক, কারণ এটি পবিত্রতার প্রতীক।
📖 🕉️ উপনিষদে ‘ওঁ’-এর ব্যাখ্যা:
- মাণ্ডুক্য উপনিষদ সম্পূর্ণরূপে ‘ওঁ’-এর উপর ভিত্তি করে রচিত।
“ওঁ এতদক্ষরং ইদং সর্বং” — ওঁ-এই এক অক্ষরই সর্বস্ব।
এখানে বলা হয়েছে, ওঁ ধ্বনির মধ্যে লুকিয়ে আছে:
- জাগ্রত (waking),
- স্বপ্ন (dream),
- সুপ্ত (deep sleep),
- এবং তুরীয় (চারর্থ — পরম আত্মজ্ঞান) অবস্থা।
- জাগ্রত (waking),
📗 📿 ভগবদ গীতায় ‘ওঁ’-এর গুরুত্ব:
- শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“ওঁ তৎ সৎ” – এই তিনটি শব্দ ব্রহ্মকে নির্দেশ করে (গীতা 17.23)।
- আরও বলেন:
“ওঁ ইতি একাক্ষরং ব্রহ্ম” – ‘ওঁ’ এক অক্ষরের মধ্যেই ব্রহ্ম বিরাজমান (গীতা 8.13)।
মৃত্যুর সময় কেউ যদি ‘ওঁ’ ধ্বনি স্মরণ করে, সে পরমপদ লাভ করে — এই কথাও গীতায় বলা হয়েছে।
📜 অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ:
- যোগসূত্র, পুরাণ, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থেও ‘ওঁ’-কে পরম মন্ত্র, সর্বশ্রেষ্ঠ শব্দ এবং যোগসাধনার মূল উপাদান হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সারকথা, হিন্দুধর্মের প্রতিটি স্তরে — মন্ত্র, জপ, ধ্যান, যজ্ঞ, তপস্যা ও পূজায় — ‘ওঁ’ একটি অপরিহার্য উপাদান। এটি শুধু ধ্বনি নয়, এটি শব্দ-স্বরূপ ঈশ্বর।
ধ্যান ও যোগব্যায়ামে ওঁ মন্ত্রের ব্যবহার
‘ওঁ’ মন্ত্র ধ্যান ও যোগব্যায়ামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন ঋষি-মুনিরা বিশ্বাস করতেন, ‘ওঁ’ ধ্বনির মাধ্যমে মানুষ আত্মার গভীরে পৌঁছাতে পারে এবং পরম সত্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। এই বিশ্বাস আজকের আধুনিক যোগ ও মেডিটেশনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে গেছে।
🧘♂️ ১. মন একাগ্র করার জন্য শ্রেষ্ঠ মন্ত্র:
ধ্যানে প্রবেশ করার পূর্বে যখন ‘ওঁ’ ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়, তখন মস্তিষ্কের তরঙ্গ ধীরে ধীরে আলফা ও থিটা অবস্থায় চলে যায় — যা মনকে শান্ত ও স্থির করে। এতে মনোসংযোগ (Concentration) অনেক গুণ বেড়ে যায়।
🌬️ ২. শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মিল রেখে জপ:
যোগচর্চায় ‘ওঁ’ ধ্বনি প্রাণায়াম (শ্বাসনিয়ন্ত্রণ) এর সাথে একত্রে জপ করা হয়।
- দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ‘ওঁ’ ধ্বনির ধীরে ধীরে উচ্চারণ শরীরের সমস্ত কোষে কম্পন সৃষ্টি করে।
- এতে স্নায়ুব্যবস্থা শান্ত হয় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে।
🔔 ৩. ধ্বনির কম্পন ও চক্র জাগরণ:
যোগতত্ত্বে বিশ্বাস করা হয়, মানবদেহে অবস্থিত সাতটি চক্র বা শক্তিকেন্দ্র ধ্বনি ও কম্পনের মাধ্যমে জাগ্রত করা যায়।
- ওঁ ধ্বনির কম্পন আজ্ঞা চক্র (ভ্রূমধ্যস্থলে) এবং সহস্রার চক্র (মাথার উপর) সক্রিয় করে, যা আত্মজ্ঞান ও উদিত চেতনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
📿 ৪. প্রতিদিনের ধ্যানচর্চায় ব্যবহার:
ধ্যান শুরু ও শেষে একাধিকবার ‘ওঁ’ জপ করলে ধ্যান আরও গভীর হয়। অনেক ধ্যানশিক্ষক ও যোগগুরু পরামর্শ দেন —
👉 দিনে অন্তত ২১ বার অথবা ১০৮ বার ‘ওঁ’ জপ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে।
📢 ৫. গ্রুপ মেডিটেশনেও ব্যবহৃত:
যোগাশ্রম, আশ্রম বা মেডিটেশন সেন্টারে বহু মানুষ একসাথে ‘ওঁ’ ধ্বনি জপ করে। এই সম্মিলিত ধ্বনি সারা পরিবেশকে একটি পবিত্র ও নিরিবিলি তরঙ্গে পরিণত করে।
সারসংক্ষেপে, ‘ওঁ’ মন্ত্র শুধুমাত্র শব্দ নয় — এটি এক গভীর যোগসাধনার দরজা, যা ধ্যানের মাধ্যমে আত্মার উন্মোচন ঘটায়। তাই যোগব্যায়াম ও ধ্যানচর্চায় ‘ওঁ’ হল প্রাণস্বরূপ।
আরো পড়ুন :সুগন্ধা শক্তিপীঠের পৌরাণিক ইতিহাস
‘ওঁ’ ধ্বনির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণা
যেখানে প্রাচীন ঋষিরা ‘ওঁ’ ধ্বনিকে আত্মিক উন্নতির পথ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, সেখানেই আধুনিক বিজ্ঞানও আজ এই মন্ত্রের কার্যকারিতা ও প্রভাবকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বহু গবেষণা ও পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ‘ওঁ’ ধ্বনি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক নয়, বরং মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরও গভীর প্রভাব ফেলে।
🧠 ১. মস্তিষ্কে ইতিবাচক পরিবর্তন:
ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে—
- ‘ওঁ’ ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় EEG স্ক্যান-এ ব্রেন ওয়েভের স্থিতিশীলতা ও প্রশান্তি লক্ষ্য করা যায়।
- এটি Prefrontal Cortex (চিন্তা ও সিদ্ধান্তের কেন্দ্র)-এ রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দেয়, ফলে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।
💓 ২. স্নায়ুতন্ত্রে ইতিবাচক প্রভাব:
‘ওঁ’ জপের সময় শ্বাস ধীরে হয় এবং হৃদস্পন্দন নিয়মিত হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়া:
- Parasympathetic Nervous System কে সক্রিয় করে, যা শরীরকে বিশ্রামে রাখে।
- স্ট্রেস হরমোন (Cortisol) এর মাত্রা হ্রাস করে।
🔬 ৩. কোষীয় কম্পনের সাথে সামঞ্জস্য:
‘ওঁ’ ধ্বনি একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে (প্রায় 432 Hz) কম্পন সৃষ্টি করে, যা বলা হয় “ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সি অব দ্য ইউনিভার্স”।
এই কম্পন দেহের কোষগুলিকে একটি সুসমবায় অবস্থায় নিয়ে আসে এবং কোষের পুনরুজ্জীবন (regeneration) প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
🛌 ৪. মানসিক চাপ ও নিদ্রার গুণমান বৃদ্ধি:
যুক্তরাষ্ট্রে করা এক ক্লিনিকাল গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে —
- নিয়মিত ‘ওঁ’ জপকারী ব্যক্তিরা অন্যদের তুলনায় ভালো ঘুমান, কম উদ্বিগ্ন থাকেন এবং বিষণ্নতার হার অনেক কম।
🧘 ৫. MRI গবেষণার ফলাফল:
AIIMS, Delhi-তে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে,
- ‘ওঁ’ ধ্বনি জপের সময় Amygdala (ভয়ের কেন্দ্র) ও Thalamus (তথ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র) — উভয়ই রিল্যাক্স মুডে চলে যায়।
- ফলে দেহ ও মন দুটোই গভীর শান্তিতে প্রবেশ করে।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, আধুনিক বিজ্ঞানও এখন স্বীকার করছে যে ‘ওঁ’ ধ্বনি একটি প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক থেরাপি, যা মানসিক সুস্থতা, স্নায়ুব্যবস্থার ভারসাম্য এবং আত্মিক চেতনার বিকাশে কার্যকর।
শরীর ও মনে ওঁ ধ্বনির প্রভাব
‘ওঁ’ মন্ত্র উচ্চারণ ও ধ্যানের মাধ্যমে যে কম্পন তৈরি হয়, তা শরীর ও মনের ওপর গভীর ও বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে। এটি শুধু একটি শব্দ নয়, বরং এক প্রকার শক্তি প্রবাহ, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
🫀 ১. হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ ও রক্তচাপ হ্রাস
ওঁ ধ্বনি উচ্চারণ করলে শরীরের ভিতরে এক ধরনের প্রশান্ত কম্পন সৃষ্টি হয়, যা:
- হৃদস্পন্দনকে ধীরে ও নিয়মিত করে,
- উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে,
- হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।
🧠 ২. মনকে শান্ত ও মনোযোগ বৃদ্ধি
এই মন্ত্র উচ্চারণের ফলে মস্তিষ্কের এলাকা বিশেষ করে ফ্রন্টাল কর্টেক্স সক্রিয় হয়, যা:
- মনোসংযোগ ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে,
- উদ্বেগ, হতাশা ও মানসিক চাপ কমায়,
- মনকে স্থির ও স্বচ্ছন্দ রাখে।
🌬️ ৩. শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ
ওঁ জপ করার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে ও নিয়মিত হয়, যা:
- ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে,
- শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ উন্নত করে,
- শরীর ও মস্তিষ্ককে বেশি প্রাণবন্ত ও সতেজ রাখে।
🔄 ৪. শক্তি প্রবাহ ও অস্থিরতা কমানো
মন্ত্রের কম্পনের মাধ্যমে শরীরের চক্রসমূহ (chakras) সক্রিয় হয় এবং শক্তির সঠিক প্রবাহ নিশ্চিত হয়, যা:
- অস্থিরতা ও উদ্বেগ কমায়,
- মন ও শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে।
💤 ৫. ভালো ঘুম ও মানসিক বিশ্রাম
নিয়মিত ‘ওঁ’ জপ করলে নিদ্রার গুণমান বৃদ্ধি পায় এবং ঘুম গভীর হয়, ফলে শরীর ও মস্তিষ্ক যথেষ্ট বিশ্রাম পায়।
এই সব প্রভাবের মাধ্যমে ‘ওঁ’ মন্ত্র জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং ব্যক্তিকে শান্ত, সুখী ও স্বাস্থ্যবান করে তোলে।
আরো পড়ুন :হিন্দু রীতি-নীতি জীবন ও সমাজে প্রাচীন মূল্যবোধের গুরুত্ব
‘ওঁ’ জপের নিয়ম ও উপযুক্ত সময়
‘ওঁ’ মন্ত্রের পূর্ণ শক্তি ও সুফল লাভের জন্য নিয়ম মেনে জপ করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে মন্ত্রের আধ্যাত্মিক ও শারীরিক প্রভাব আরও গভীর হয়।
📿 ১. জপের নিয়ম:
- পরিষ্কার ও শুদ্ধ মন নিয়ে শুরু করুন:
ধ্যান বা জপের আগে হাত ধুয়ে নিন এবং একটি শান্ত স্থানে বসুন। মন থেকে নেতিবাচক চিন্তা সরিয়ে নিন।
- সোজা পিঠ ও স্বচ্ছন্দ আসন:
পদ্মাসন, স্বস্তিকাসন বা যে কোনো আরামদায়ক আসনে বসুন যাতে দীর্ঘ সময় বসতে পারেন।
- মন্ত্র উচ্চারণ ধীরে ও স্পষ্টভাবে:
‘ওঁ’ মন্ত্রটি ধীরে, গভীর ও সঠিক ধ্বনিতে উচ্চারণ করুন।
বেশি গতি করলে এর প্রভাব কমে যায়।
- শ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখুন:
দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ‘ওঁ’ উচ্চারণ করুন, যেমনঃ শ্বাস নিন—ধীরে ধীরে উচ্চারণ করুন—তারপর ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ুন।
- জপের সংখ্যা:
সাধারনত ২১, ৫৪, ১০৮ বা ২১৬ বার ‘ওঁ’ জপ করা হয়। বিশেষ করে ১০৮ বার জপ অত্যন্ত পবিত্র গণনা করা হয়।
🕰️ ২. উপযুক্ত সময়:
- ভোরবেলা (ব্রাহ্মমুহূর্ত):
প্রভাত ৪টা থেকে ৬টার মধ্যে সময়টি সবচেয়ে পবিত্র ও ফলপ্রসূ বলে ধরা হয়।
- সন্ধ্যায় ধ্যানের পূর্বে:
সূর্যাস্তের পরে মন শান্ত করার জন্য ‘ওঁ’ জপ করা যায়।
- যেকোনো সময় মানসিক শান্তি প্রয়োজন হলে:
উদ্বেগ, চিন্তা বা মানসিক চাপ কমানোর জন্য যেকোনো সময় ‘ওঁ’ উচ্চারণ করা যেতে পারে।
🧘♀️ ৩. নিয়মিত অভ্যাস:
সর্বোচ্চ সুফল পাওয়ার জন্য প্রতিদিন নিয়মিত ‘ওঁ’ মন্ত্র জপের অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রতিদিন একই সময়ে করার চেষ্টা করুন, যাতে এটি আপনার দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
এই নিয়মগুলো মেনে ‘ওঁ’ জপ করলে, আপনি শুধু আধ্যাত্মিক শান্তি পাবেন না, বরং শরীর ও মনের সুস্থতাও নিশ্চিত করতে পারবেন।
শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ওঁ ধ্বনির সংযোগ
‘ওঁ’ মন্ত্র উচ্চারণের সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের সঠিক নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রের শক্তিকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। শ্বাস ও ধ্বনির সমন্বয় শরীর ও মনের গভীর প্রশান্তি ও সামঞ্জস্য তৈরিতে সাহায্য করে।
🌬️ ১. শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ:
- দীর্ঘশ্বাস গ্রহণ: ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিন, যাতে ফুসফুস সম্পূর্ণরূপে অক্সিজেন দিয়ে ভরে যায়।
- শ্বাসে মন্ত্র উচ্চারণ: শ্বাস ত্যাগ করার সময় ধীরে ধীরে ‘ওঁ’ উচ্চারণ করুন, যাতে ধ্বনিটি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
- নিয়মিত ও সমান শ্বাস: শ্বাসের দৈর্ঘ্য ও মন্ত্র উচ্চারণের দৈর্ঘ্য সমান রাখতে চেষ্টা করুন, এতে মন এবং শরীরের সঙ্গতি বজায় থাকে।
🧘♂️ ২. শ্বাস ও ধ্বনির সংযোগের উপকারিতা:
- শ্বাসের সঙ্গে ধ্বনি মিলানোর ফলে শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে, যা মানসিক চাপ কমায়।
- এটি অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে, ফলে শরীরের কোষগুলো প্রাণবন্ত ও সুস্থ থাকে।
- শ্বাস-ধ্বনি সমন্বয়ের মাধ্যমে ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি পায়, মনের বিভ্রান্তি কমে আসে।
- নিয়মিত চর্চায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হয়।
🔄 ৩. প্র্যাকটিসের সহজ পদ্ধতি:
১. ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিন।
২. শ্বাস ছাড়ার সময় ধীরে ধীরে ‘ওঁ’ ধ্বনি উচ্চারণ করুন, প্রায় ৫-৭ সেকেন্ড ধরে।
৩. কয়েক সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ রাখুন।
৪. আবার ধীরে ধীরে শ্বাস নিন এবং পুনরাবৃত্তি করুন।
শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ‘ওঁ’ মন্ত্রের এই সমন্বয় শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। এটি ধ্যানকে আরও শক্তিশালী করে এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি ও প্রজ্ঞা অর্জনে সাহায্য করে।
‘ওঁ’ ধ্বনি ও চক্র জাগরণ (Chakra Activation)
যোগ ও আধ্যাত্মিক শাস্ত্রে মানবদেহে সাতটি শক্তিকেন্দ্র বা চক্র রয়েছে, যা শরীর ও চেতনার বিভিন্ন স্তর নিয়ন্ত্রণ করে। এই চক্রগুলো সঠিকভাবে সক্রিয় ও সুষম হলে জীবনশক্তি প্রবাহিত হয় এবং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় থাকে। ‘ওঁ’ মন্ত্রের উচ্চারণের কম্পন এই চক্রগুলো জাগ্রত করার এক শক্তিশালী মাধ্যম।
🔮 চক্রগুলো ও তাদের ভূমিকা:
১. মুলাধার চক্র: শারীরিক ভিত্তি ও নিরাপত্তা।
২. স্বাধিষ্ঠান চক্র: সৃষ্টিশীলতা ও আবেগ।
৩. মণিপুর চক্র: আত্মবিশ্বাস ও শক্তি।
৪. অনাহত চক্র: প্রেম ও করুণা।
৫. বিশুদ্ধি চক্র: যোগাযোগ ও প্রকাশ।
৬. আজ্ঞা চক্র: অন্তর্দৃষ্টি ও বুদ্ধি।
৭. সহস্রার চক্র: সর্বোচ্চ চেতনা ও আত্মা।
🕉️ ওঁ মন্ত্রের কম্পন ও চক্র জাগরণ:
- ‘ওঁ’ মন্ত্রের কম্পন বিশেষত আজ্ঞা চক্র (ভ্রূমধ্য) ও সহস্রার চক্র (মাথার শীর্ষ) সক্রিয় করে। এই দুই চক্র মানব জীবনের উচ্চতর চেতনা ও আত্মজ্ঞান কেন্দ্র।
- মন্ত্র উচ্চারণের সময় মাথা ও কপালের অংশে স্পন্দন অনুভূত হয়, যা চক্রগুলোকে সচল করে শক্তির মুক্তি ঘটায়।
- নিয়মিত ‘ওঁ’ জপের মাধ্যমে মুলাধার থেকে সহস্রার পর্যন্ত শক্তির প্রবাহ সঠিকভাবে সচল হয়, যার ফলে মানসিক শান্তি, সুস্থতা ও সমৃদ্ধি আসে।
✨ ধ্যান ও শক্তি সমন্বয়:
যোগ ও ধ্যানের সময় ‘ওঁ’ উচ্চারণ করলে ধ্যানী ব্যক্তি তার অভ্যন্তরীণ শক্তি ও চেতনা প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়। এটি চক্রের বাধা দূর করে, চেতনার গভীরতায় পৌঁছাতে সাহায্য করে।
সারকথা, ‘ওঁ’ মন্ত্র শুধু একটি শব্দ নয়, এটি শক্তি ও চেতনার প্রবাহের প্রতীক। এর সঠিক ব্যবহার চক্রগুলোকে জাগিয়ে জীবনের সমস্ত স্তরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
ওঁ মন্ত্রের দ্বারা মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা হ্রাস
আজকের দ্রুতগামী জীবনযাত্রায় মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা একটি বড় সমস্যা। ‘ওঁ’ মন্ত্রের জপ ও ধ্যান এই সমস্যা মোকাবেলায় প্রাচীন ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এক কার্যকরী উপায়।
🧠 ১. মনকে শিথিল করার ক্ষমতা
‘ওঁ’ উচ্চারণের কম্পন মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে প্রশমিত করে। এটি:
- অতিরিক্ত চিন্তা ও উদ্বেগ কমায়
- মস্তিষ্ককে আরাম ও স্থিতিশীলতা প্রদান করে
- ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ রেসপন্স হ্রাস করে, যার ফলে মানসিক চাপ কমে।
🧘♂️ ২. ধ্যান ও মন্ত্রজপের মাধ্যমে চাপ হ্রাস
নিয়মিত ‘ওঁ’ মন্ত্রের জপ করলে:
- শরীরের প্যারাসিম্প্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় হয়, যা দেহকে শান্ত অবস্থায় নিয়ে আসে।
- স্ট্রেস হরমোন কোর্টিসল এর মাত্রা হ্রাস পায়।
- মনের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তা ও আবেগ বৃদ্ধি পায়।
😌 ৩. আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি
‘ওঁ’ মন্ত্র জপের মাধ্যমে:
- মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- দুশ্চিন্তা ও নেতিবাচক ভাবনা কমিয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
- মানসিক স্থিতিশীলতা এনে দেয়, যা দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় কার্যকর।
💤 ৪. মানসিক বিশ্রাম ও ভালো ঘুম
শান্ত মনের জন্য ‘ওঁ’ ধ্যান অত্যন্ত কার্যকর। এটি:
- ঘুমের মান উন্নত করে,
- বিষণ্নতা ও উদ্বেগ কমিয়ে গভীর বিশ্রামের সুযোগ দেয়।
সারসংক্ষেপে, ‘ওঁ’ মন্ত্রের নিয়মিত উচ্চারণ ও ধ্যান মানসিক চাপ কমিয়ে জীবনে শান্তি, সুখ ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। আধুনিক জীবনের টানাপোড়েনে এটি এক প্রাকৃতিক ও সহজ চিকিৎসার পথ।
১৩. বিভিন্ন ধর্মে ওঁ-এর অবস্থান
‘ওঁ’ মন্ত্র শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, অন্যান্য ধর্ম ও আধ্যাত্মিক প্রথাতেও এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এটি ধর্মনিরপেক্ষভাবে সর্বজনগ্রাহ্য এক চেতনাধ্বনি, যা মানব জীবনের গভীরতম সত্য ও শান্তির প্রতীক।
🕉️ ১. হিন্দুধর্মে ‘ওঁ’:
- হিন্দুধর্মের প্রধান মন্ত্র ও সর্বোচ্চ প্রতীক হিসেবে ‘ওঁ’ ধরা হয়।
- এটি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, রক্ষা ও লয়ের ধ্বনি হিসেবে বিবেচিত।
- পূজা, যজ্ঞ, ধ্যান ও মন্ত্রজপে ‘ওঁ’ অনিবার্য।
☸️ ২. বৌদ্ধ ধর্মে ‘ওঁ’:
- বৌদ্ধ চ্যান ও তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মে ‘ওঁ’ মন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- বিশেষ করে তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মে ‘ওঁ’ ধ্বনি ‘মণি প্যাড্মে হুম’ মন্ত্রের প্রথম অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- এটি শুদ্ধতা ও করুণার প্রতীক।
🕉️ ৩. জৈন ধর্মে ‘ওঁ’:
- জৈন ধর্মে ‘ওঁ’ ধ্বনিকে পাঁচ প্রধান পবিত্র শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
- এটি ধর্ম, জ্ঞান, অহিংসা, সত্য ও পরমার্থের সম্মিলিত প্রতীক।
✡️ ৪. অন্যান্য ধর্ম ও আধ্যাত্মিক প্রথায়:
- বিভিন্ন নব্য আধ্যাত্মিক আন্দোলনে ‘ওঁ’ ধ্বনি ব্যবহার করা হয় মনের শান্তি ও আত্মিক উন্নতির জন্য।
- নিউ এজ আন্দোলনেও ‘ওঁ’ কে একটি সার্বজনীন চেতনাধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
সারাংশে, ‘ওঁ’ মন্ত্র ধর্ম ও সংস্কৃতির সীমা ছাড়িয়ে একটি বিশ্বজনীন আত্মিক শক্তি ও শান্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এটি মানুষের মনের গভীর শান্তি ও চেতনা প্রসারে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
আধুনিক যুগে ওঁ মন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা
বিশ্ব আজ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সহজ হলেও মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি ততটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ‘ওঁ’ মন্ত্রের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
🌐 ১. মানসিক শান্তির অন্যতম মাধ্যম
- আধুনিক জীবনের স্ট্রেস ও উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে মানুষ নতুন নতুন উপায় খুঁজছেন।
- ‘ওঁ’ মন্ত্রের জপ ও ধ্যান মনকে শান্ত করে, মানসিক স্থিরতা এনে দেয়।
- এটি মেডিটেশন ও মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিসের এক অঙ্গ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
🧘♀️ ২. যোগব্যায়াম ও ধ্যানচর্চায় অপরিহার্য
- আধুনিক যোগ ও মেডিটেশন কেন্দ্রগুলোতে ‘ওঁ’ মন্ত্র জপ করার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা হয়।
- এর মাধ্যমে মনোযোগ বৃদ্ধি, উদ্বেগ হ্রাস এবং একাগ্রতা অর্জন সহজ হয়।
💻 ৩. প্রযুক্তির যুগে আত্মিক সংযোগের সেতু
- ডিজিটাল ও ভার্চুয়াল জীবনে মানুষ প্রায়শই আত্মিক বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে।
- ‘ওঁ’ মন্ত্রের মাধ্যমে তারা নিজের ভিতরের শান্তি ও শক্তির সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত হতে পারে।
🌿 ৪. স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় সাহায্যকারী
- স্ট্রেস রিলিফ, ভালো ঘুম, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য ‘ওঁ’ মন্ত্রের ভূমিকা আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত।
- তাই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষরা ধ্যানের অংশ হিসেবে নিয়মিত ‘ওঁ’ উচ্চারণের অভ্যাস তৈরি করছেন।
সারকথা, আধুনিক জীবনের জটিলতা ও চাপের মাঝে ‘ওঁ’ মন্ত্র এক প্রাকৃতিক শান্তির উপায় ও আত্মিক পুনর্জাগরণের শক্তি হিসেবে অক্ষুণ্ণভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ওঁ মন্ত্রের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক প্রভাব
‘ওঁ’ মন্ত্র শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক চেতনাকে জাগ্রত করে না, এটি সামাজিক স্তরেও সুসংহত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
🕉️ ১. আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস
‘ওঁ’ মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের অন্তর্দৃষ্টি, শান্তি ও সত্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এটি আত্মশুদ্ধির পথ সুগম করে এবং জীবনের গভীর অর্থ উপলব্ধিতে সাহায্য করে।
🤝 ২. সামাজিক ঐক্য ও সংহতি
- ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একসঙ্গে ‘ওঁ’ ধ্বনি উচ্চারণ সামাজিক বন্ধন ও ঐক্যকে শক্তিশালী করে।
- এটি বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে সাম্যবোধ ও সৌহার্দ্য বাড়ায়।
🌍 ৩. মানসিক শান্তি ও সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি
- ‘ওঁ’ মন্ত্রের ধ্বনি মানুষের মনের মধ্যে ধৈর্য, সহানুভূতি ও করুণা বিকাশে সাহায্য করে।
- মানসিক শান্তির ফলে সমাজে হিংসা ও বিরোধ কমে।
🎶 ৪. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ
‘ওঁ’ মন্ত্র আমাদের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর ধারাবাহিক প্রচার ও চর্চা সমাজকে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধে সংহত রাখে।
সারসংক্ষেপে, ‘ওঁ’ মন্ত্র ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক সমন্বয় ও শান্তির মাধ্যম হিসেবে কার্যকর। এটি সমাজে সুস্থ, সদয় ও ঐক্যবদ্ধ পরিবেশ গড়ে তুলতে বিশেষ অবদান রাখে।
‘ওঁ’ মন্ত্র শুধু একটি শব্দ নয়, এটি আত্মার গভীরতম চেতনা এবং ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, রক্ষা ও লয়ের সারমর্ম বহন করে। প্রাচীন কাল থেকে এটি আধ্যাত্মিক সাধনা, ধ্যান এবং যোগব্যায়ামের মূলে রয়েছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাও প্রমাণ করেছে ‘ওঁ’ মন্ত্রের উচ্চারণ শরীর ও মনের সুস্থতা এবং মানসিক শান্তিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
আজকের দ্রুতগামী জীবনযাত্রায় যেখানে চাপ ও উদ্বেগ বেড়ে চলেছে, সেখানে ‘ওঁ’ মন্ত্র আমাদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। এটি আমাদের অন্তরকে শুদ্ধ করে, মনকে স্থির করে এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত করে। ব্যক্তি ও সমাজের সমৃদ্ধি এবং শান্তির জন্য ‘ওঁ’ মন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
সুতরাং, নিয়মিত ‘ওঁ’ মন্ত্র জপ ও ধ্যান আমাদের জীবনে নতুন শক্তি, শান্তি এবং সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে। এটি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ নয়, বরং সমগ্র মানবজীবনের মানোন্নয়নের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।
আরো পড়ুন : শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর গুরুত্ব