রথযাত্রা একটি প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় উৎসব যা প্রতি বছর আষাঢ় মাসে পালন করা হয়। এই উৎসব মূলত জগন্নাথ দেব, তাঁর ভাই বলরাম এবং বোন সুভদ্রার মন্দির থেকে বাহির হয়ে রথে চড়ে জনসাধারণের মধ্যে গমনকে কেন্দ্র করে উদযাপন করা হয়। এটি আধ্যাত্মিকতা, ঐতিহ্য এবং ভক্তির এক অসামান্য নিদর্শন। পুরী, ওড়িশার রথযাত্রা সর্বাধিক বিখ্যাত হলেও বর্তমানে বিশ্বের নানা দেশে এই উৎসব পালিত হয়। নিচে রথযাত্রার ইতিহাস, মাহাত্ম্য, ধর্মীয় গুরুত্ব ও বিশ্বব্যাপী প্রসার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
রথযাত্রার ইতিহাস
রথযাত্রার উৎপত্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি জগন্নাথ নামে পূজিত হন। হিন্দু পুরাণ মতে, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা কুরুশেত্র দর্শনে যান, যেখানে তাদের আত্মীয়রা তাদের রথে করে নিয়ে যায়। এই ঘটনাকেই রূপক অর্থে রথযাত্রার সূত্রপাত বলা হয়।
পুরাণ ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, জগন্নাথ দেবের পূজা ও রথযাত্রা পালনের প্রচলন শুরু হয়েছিলো প্রায় ৮০০ বছরেরও আগে। রাজা অনঙ্গভীমা দেব ওড়িশার পুরীতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করেন এবং সেই মন্দির থেকেই আজ অবধি রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রাচীন কাল থেকে এ উৎসবের মাধ্যমে ভগবানকে মন্দির থেকে বের করে এনে জনগণের সামনে আনা হয়, যার পেছনে রয়েছে এক গভীর ধর্মীয় তাৎপর্য।
রথ যাত্রা কীভাবে শুরু হলো?
রথযাত্রার শুরুর পিছনে রয়েছে এক দারুণ ধর্মীয় বার্তা। হিন্দু বিশ্বাস মতে, ভগবান শুধুমাত্র মন্দিরে আবদ্ধ নন—তিনি সকলের, গৃহহীন, দরিদ্র, সাধারণ মানুষেরও। সেই কারণে রথযাত্রার দিন ভগবানকে রথে বসিয়ে মন্দিরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে সব শ্রেণির মানুষ তাঁকে দর্শন করতে পারে।
রথ তৈরির রীতি শুরু হয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে। তিনি স্বপ্নে আদেশ পান একটি বিশেষ কাঠ দিয়ে তিনটি মূর্তি (জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা) তৈরি করার। এই তিন দেবতার প্রতিকৃতি তৈরি ও প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রথযাত্রার প্রথা চালু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর নতুন করে তিনটি রথ তৈরি হয় এবং উৎসবটি পালিত হয়।
জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা কিভাবে তৈরি হয়েছেন?
জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার প্রতিমা তৈরি নিয়ে রয়েছে এক বিশেষ কাহিনি। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নে নির্দেশ পান তিনটি বিশেষ মূর্তি তৈরি করতে। তিনি এক কাঠুরেকে মূর্তি তৈরির জন্য নিযুক্ত করেন, যিনি আদতে ছিলেন বিশ্বকর্মা। তিনি বলেছিলেন, যতক্ষণ না কাজ শেষ হচ্ছে, কেউ যেন ঘরে প্রবেশ না করে। রাজা অধৈর্য হয়ে দরজা খুলে ফেলেন এবং সেই মুহূর্তেই বিশ্বকর্মা অন্তর্হিত হন।
ফলে মূর্তিগুলি সম্পূর্ণ হয় না—জগন্নাথের হাত ও পা অসম্পূর্ণ, বলরাম ও সুভদ্রার গঠনও ভিন্নরকম। কিন্তু এই অর্ধসমাপ্ত অবস্থাকে ভগবানের ইচ্ছা হিসেবে মেনে নিয়ে মূর্তিগুলিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই থেকেই এই রূপে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার পূজা হয়ে আসছে।
কেন রথযাত্রা পালন করা হয় ?
রথযাত্রা পালন করা হয় ভগবানের দর্শনলাভ, পাপক্ষয় ও পুন্য অর্জনের জন্য। এই দিনে রথ টানা, প্রসাদ বিতরণ, কীর্তন, ভজন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ ভগবানের প্রতি নিজের ভক্তি নিবেদন করে।
রথযাত্রা পালন করলে:
- পাপ মোচন হয়
- পূণ্য লাভ হয়
- ইচ্ছাপূরণ হয়
- আত্মিক শান্তি ও মুক্তি লাভ হয়
এছাড়া রথ টানা মানে শুধু শারীরিক কাজ নয়, এটি আত্মিকভাবে ভগবানকে নিজের জীবনে স্থান দেওয়ার প্রতীক।
কত দিন ধরে রথযাত্রা পালন করা হয়?
রথযাত্রা সাধারণত ৯ দিন ধরে চলে। এর মধ্যে:
১ম দিন: প্রথম দিন: রথযাত্রা – জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দিরে যাত্রা করেন।
- তিন দেবতা রথে চড়ে শ্রীমন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দিরে যাত্রা করেন।
- লাখ লাখ ভক্ত রথ টানেন।
- রাস্তায় ভজন, কীর্তন, নৃত্য হয়।
- রথ টানাকে পুণ্য কর্ম বলে ধরা হয়।
✅ ২য়–৮ম দিন: গুন্ডিচা মন্দিরে অবস্থান
এই দিনগুলোতে দেবতারা মাসির বাড়ি (গুন্ডিচা মন্দিরে) অবস্থান করেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই সময় ঘটে:
🔸 ২য় দিন – “গুন্ডিচা গৃহ” প্রবেশ
- তিন দেবতা গুন্ডিচা মন্দিরে প্রবেশ করেন।
- বিশেষ পূজা ও ভোগ নিবেদন হয়।
🔸 ৩য়–৪র্থ দিন – ‘গর্ভগৃহে অবস্থান’
- দেবতারা স্থায়ীভাবে গুন্ডিচা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত থাকেন।
- ভক্তরা মন্দিরে গিয়ে দর্শন করেন।
🔸 ৫ম দিন – “হেরাপঞ্চমী”
- লক্ষ্মী দেবী শ্রীমন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দিরে এসে প্রতীকীভাবে রাগ প্রকাশ করেন কারণ জগন্নাথ তাঁকে ছেড়ে গিয়েছেন।
- এটি এক নাটকীয় ধর্মীয় পর্ব।
🔸 ৬–৭ম দিন – ভোগ নিবেদন, সেবা, দর্শন
- দেবতাদের বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয় (পদ্মভোগ, চপান ভোগ)।
- হাজারো ভক্ত লাইন দিয়ে দর্শন করেন।
🔸 ৮ম দিন – রথ প্রস্তুতি
- ভক্তরা রথগুলো আবার পরিষ্কার করেন, সাজান এবং নতুনভাবে প্রস্তুত করেন মূল মন্দিরে ফেরার জন্য।
৯ম দিন: উল্টো রথ বা বাহুডা যাত্রা – দেবতারা মূল মন্দিরে ফিরে আসেন।
- দেবতারা তাঁদের রথে চড়ে আবার শ্রীমন্দিরে ফিরে যান।
- এটি “বাহুড়া যাত্রা” নামে পরিচিত।
- পথে মৌসিমা মন্দিরে (অর্থাৎ জগন্নাথের মাসির বাড়ির) সামনে রথ থামে এবং সেখানে বিশেষ ভোগ (পোড়া পিঠা) নিবেদন করা হয়।
- সন্ধ্যায় মন্দিরে পৌঁছে ‘সুনা বেসা’ অর্থাৎ সোনার অলংকারে দেবতাদের সাজানো হয়।
- এই সাজ দেখা অত্যন্ত পুণ্য বলে ধরা হয়।
- রাতে দেবতারা মন্দিরে প্রবেশ করেন।
⭐ বিশেষ তাৎপর্য:
- এই ৯ দিনের প্রতিটি দিনই ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
- ভক্তরা মনে করেন, এই সময়ে ভগবানের সরাসরি সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ মেলে।
- যারা এই সময় পূজা, রথ টানা, ভোগদান বা কীর্তন করেন, তাঁদের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও মুক্তি আসে।
এই ৯ দিন পুরী শহর এক আধ্যাত্মিক আবহে মোড়ানো থাকে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ ভগবানের দর্শনের জন্য জড়ো হন।
উল্টো রথ কেন করা হয়?
উল্টো রথ বা বাহুডা যাত্রা হচ্ছে রথযাত্রার নবম দিনে পালিত ফেরার যাত্রা। দেবতারা প্রথমে গুন্ডিচা মন্দিরে যান, যা তাঁদের মাসির বাড়ি হিসেবে ধরা হয়। সেখানে তাঁরা ৭ দিন অবস্থান করেন। এরপর তাঁরা আবার মূল মন্দিরে ফিরে আসেন।
উল্টো রথ মানে হচ্ছে, জীবনের যেমন সূচনা আছে, তেমনই প্রত্যাবর্তন আছে। এটি এক ধরনের পুনর্মিলনের প্রতীক। মানুষ যেমন ঈশ্বরের কাছ থেকে কিছু চায়, তেমনি শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে তাঁরই আশ্রয়ে।
উল্টো রথের মাহাত্ম্য
উল্টো রথকে অত্যন্ত পূণ্যজনক দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। এই দিনে দেবতাদের দর্শন এবং রথ টানা করলে জীবনে বিশেষ বর লাভ হয় বলে বিশ্বাস। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো:
- এই দিনে জগন্নাথ মন্দিরে “সুনা বেসা” বা সোনার অলংকারে দেবতাদের সাজানো হয়।
- এই সাজ দেখলে জীবনে সৌভাগ্য ও সফলতা আসে বলে বিশ্বাস।
রথযাত্রা বর্তমানে শুধুমাত্র ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক হিন্দু সংস্থা ISKCON বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রথযাত্রা আয়োজন করে। নিচে কিছু দেশের নাম দেওয়া হলো:
বাংলাদেশ ,ভারত ,যুক্তরাষ্ট্র ,যুক্তরাজ্য ,অস্ট্রেলিয়া ,কানাডা ,মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিজি, সাউথ আফ্রিকা সহ আরও অনেক দেশে এই উৎসব পালিত হয়।
এইসব দেশে ভক্তরা রাস্তায় রথ টানেন, কীর্তন করেন, প্রসাদ বিতরণ করেন এবং সংস্কৃতির একতা প্রদর্শন করেন।
রথযাত্রা একটি অনন্য ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক উৎসব। এটি কেবলমাত্র ভক্তি ও ভগবানের দর্শনের একটি রীতিমাত্র নয়, বরং একটি জীবনদর্শন। এই উৎসব আমাদের শেখায় নীচু-উঁচু ভেদাভেদ ভুলে ভগবানের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। প্রতিটি মানুষের উচিত অন্তত একবার রথযাত্রা প্রত্যক্ষ করা এবং নিজের হৃদয়ে ভগবানের রথ টেনে আনা।
এইভাবেই রথযাত্রা আমাদের জীবনে আনে শুভতা, শান্তি এবং আত্মিক উন্নতি।