সুগন্ধা শক্তিপীঠ
সুগন্ধা শক্তিপীঠ হিন্দু ধর্মে শক্তিপীঠগুলোর রয়েছে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক গুরুত্ব। সতীদেবীর অঙ্গপতনের কাহিনী অনুযায়ী গড়ে উঠেছে একাধিক শক্তিপীঠ, যেগুলোর প্রতিটিই পূর্ণ পবিত্রতা ও শ্রদ্ধার কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের বরিশাল জেলার শিকারপুর গ্রামে অবস্থিত সুগন্ধা শক্তিপীঠ সেই ৫১টি প্রধান সতীপীঠের একটি। দেবী সুনন্দা এবং ভৈরব ত্র্যায়ম্বকেশ্বর এখানে পূজিত হন। প্রতিবছর হাজারো ভক্ত এখানে পূণ্যলাভের আশায় আসেন এবং এই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডল। এ লেখায় আমরা জানব সুগন্ধা শক্তিপীঠের ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা, উৎসব, যাত্রাপথ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
সুগন্ধা শক্তিপীঠ কোথায় অবস্থিত ?
সুগন্ধা শক্তিপীঠ বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অন্তর্গত শিকারপুর গ্রামে অবস্থিত। বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১০ মাইল (প্রায় ১৬ কিলোমিটার) দূরে এই মন্দিরটি অবস্থিত। এটি সুনন্দা নদীর তীরে স্থাপিত, যেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নদীর শান্ত ধারা এক বিশেষ আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
ভক্তরা বরিশাল শহর থেকে বাস, অটো, রিকশা বা স্থানীয় যানবাহনের মাধ্যমে খুব সহজে শিকারপুর গ্রামে পৌঁছাতে পারেন। নিকটতম রেল স্টেশন ও বিমানবন্দর হলো বরিশাল শহরে। সড়ক ও নৌ-পথে যোগাযোগ সুবিধাজনক হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকেও অনেকে এখানে আসেন পুণ্যস্নান ও দেবী দর্শনের উদ্দেশ্যে।
দেবী সুনন্দা ও ভৈরব ত্র্যায়ম্বকেশ্বর
সুগন্ধা শক্তিপীঠে দেবী পূজিতা হন ‘সুনন্দা’ রূপে। পৌরাণিক মতে, দেবী সতীর নাক পতিত হওয়ার পর এখানে তাঁর ‘সুনন্দা’ রূপে অধিষ্ঠান স্থাপন হয়। দেবী সুনন্দা তন্ত্র মতে ‘রূপ ও গন্ধের দেবী’ হিসেবে পরিচিত, যিনি শান্তি, সৌন্দর্য এবং শুভতার প্রতীক। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী সুনন্দার কৃপায় জীবনে আসে সুগন্ধময় জীবন ও আত্মিক সমৃদ্ধি। এ মন্দিরে ভৈরব রূপে পূজিত হন ত্র্যায়ম্বকেশ্বর, যিনি শিবের এক বিশেষ রূপ। দেবী সুনন্দার সহচর ও রক্ষাকর্তা হিসেবে ভৈরব ত্র্যায়ম্বকেশ্বর এখানে পূজিত হয়ে থাকেন। দেবী এবং ভৈরব – এই দুই দেবত্বের মিলনে সুগন্ধা শক্তিপীঠ হয়ে উঠেছে এক শক্তিশালী আধ্যাত্মিক স্থান। এখানে দেবী ও ভৈরবের যুগল আরাধনার মাধ্যমে ভক্তরা বিশেষ পুণ্যলাভের আশায় ব্রত পালন করেন।
সুগন্ধা শক্তিপীঠের পৌরাণিক ইতিহাস
সুগন্ধা শক্তিপীঠের ইতিহাস হিন্দু পুরাণের সতীর অঙ্গপতনের কাহিনীর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। পৌরাণিক মতে, দেবী সতী তাঁর পিতা দক্ষের যজ্ঞে নিজেকে উৎসর্গ করেন। শোকাকুল শিব সতীর মৃতদেহ বহন করে বিশ্বভ্রমণে বের হন। দেবলোকের ভারসাম্য রক্ষায় ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করেন। যেখানে সতীর অঙ্গ পতিত হয়েছিল, সেখানে গড়ে ওঠে শক্তিপীঠ।
বিশ্বাস করা হয়, সুগন্ধা শক্তিপীঠে সতীর নাক পতিত হয়েছিল। সেই থেকেই এই স্থান ‘সুগন্ধা শক্তিপীঠ’ নামে পরিচিত। এখানে দেবী সুনন্দা রূপে পূজিতা হন এবং তাঁর সহচর ভৈরব হিসেবে বিরাজ করেন ত্র্যায়ম্বকেশ্বর। সতীপীঠ হিসেবে এই মন্দিরের রয়েছে তন্ত্র-ভিত্তিক শক্তিপূজার বিশেষ গুরুত্ব।
এখানে দেবী সুনন্দাকে রূপকথার ‘মহাশক্তি’ এবং ‘সৌন্দর্যের প্রতীক’ হিসেবে উপাসনা করা হয়। সতীর অংশ পতনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই স্থান ভক্তদের কাছে তীর্থস্থান ও মুক্তির পথ হিসেবে বিবেচিত।
মন্দিরের স্থাপত্য ও বৈশিষ্ট্য
সুগন্ধা শক্তিপীঠ মন্দিরের স্থাপত্য বেশ সরল ও ঐতিহ্যবাহী। মন্দিরটি মূলত ছোট আকারের হলেও এর ভেতরে বিরাজ করছেন দেবী সুনন্দার পবিত্র মূর্তি। মন্দিরের ছাদ ও গম্বুজ হিন্দু ধর্মীয় স্থাপত্যের পরিচিত ধাঁচে নির্মিত হলেও, স্থানীয় শিল্পের ছাপ রয়েছে নির্মাণশৈলীতে।
মন্দির চত্বরে রয়েছে:
প্রধান গর্ভগৃহ (গরভগৃহ)।
ছোট আকারের প্রাঙ্গণ।
পূজা-অর্চনার জন্য আলাদা স্থাপনা।
আশেপাশে রয়েছে অন্যান্য ক্ষুদ্র দেব-দেবীর মন্দির।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
মন্দিরের প্রাচীনতা ও আধ্যাত্মিক আবহ বজায় রেখে সময়ের সঙ্গে কিছু সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
মন্দিরের আশেপাশে সুনন্দা নদীর স্রোতধারা প্রবাহিত হওয়ায় স্থানটি শান্ত ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বিশেষ উৎসবের সময় মন্দির প্রাঙ্গণে আলোকসজ্জা ও সাজসজ্জার মাধ্যমে মন্দিরের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পায়।
সাধারণ দর্শনার্থী থেকে শুরু করে সাধু-সন্ন্যাসী, সকলের কাছেই মন্দিরের নির্মাণশৈলী ও পবিত্র পরিবেশ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
প্রধান উৎসব ও পূজা-পদ্ধতি
সুগন্ধা শক্তিপীঠে সারা বছর ধরে বিভিন্ন তিথি ও পূণ্যলগ্নে পূজা-অর্চনা হয়ে থাকে, তবে কিছু নির্দিষ্ট উৎসব এখানে বিশেষ গুরুত্ব পায়। ভক্তরা এই সময় মন্দিরে এসে দেবী সুনন্দা ও ভৈরব ত্র্যায়ম্বকেশ্বরের কাছে পুজো দিয়ে আশীর্বাদ লাভের আশা করেন।
প্রধান উৎসবসমূহ:
শিবচতুর্দশী
সুগন্ধা শক্তিপীঠের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হলো শিবচতুর্দশী। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে (মার্চ মাসের দিকে) অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে এই দিনে। সারারাত ধরে চলে শিবরাত্রি ব্রত, যজ্ঞ, বিশেষ পূজা ও কীর্তন।
নবরাত্রি
প্রতি বছর চৈত্র ও আশ্বিন মাসের নবরাত্রি উপলক্ষে মন্দির চত্বরে আয়োজন করা হয় বিশেষ পূজা, হোম-যজ্ঞ ও ভজন-কীর্তনের। নবরাত্রিতে প্রতিদিন বিভিন্ন রীতিতে দেবী সুনন্দার আরাধনা করা হয়।
দুর্গাপূজা ও কালীপূজা
স্থানীয়ভাবে দুর্গাপূজা ও কালীপূজাও এখানে গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়। পূজার সময় মন্দিরে ভক্তদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
প্রতিদিনের পূজা-পদ্ধতি:
সকালে: মঙ্গল আরতি, দেবী স্নান, পুষ্পাঞ্জলি ও প্রাতঃকালীন ভোগ নিবেদন।
দুপুরে: মধ্যাহ্ন আরতি, প্রসাদ বিতরণ।
সন্ধ্যায়: সন্ধ্যা আরতি, প্রদীপ দান ও ভজন-কীর্তন।
পূজা শেষে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা
বিশেষ পূণ্যলগ্নে বা সংকট থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে এখানে ভক্তরা মানত করে বিশেষ পূজা দিয়ে থাকেন। তন্ত্রশাস্ত্রের বিশেষ বিধান অনুসারে এখানে কিছু গোপন তান্ত্রিক পূজাও গোপনে পালন করা হয় বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন।
ভক্তদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা
সুগন্ধা শক্তিপীঠ দর্শনে আসা ভক্ত ও পর্যটকদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা অনুসরণ করা উচিত, যাতে মন্দিরের পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ বজায় থাকে:
বিশুদ্ধ মানসিকতা ও পরিষ্কার পোশাকে প্রবেশ করুন।
মন্দির প্রাঙ্গণে জুতো, স্যান্ডেল পরিধান নিষিদ্ধ।
পূজার সময় নীরবতা বজায় রাখা ভক্তদের কর্তব্য।
দর্শনার্থীদের জন্য আলাদা লাইনের ব্যবস্থা থাকলেও উৎসবকালে ভিড় এড়াতে সকালবেলায় যাওয়া ভালো।
মন্দির চত্বরে অপ্রয়োজনীয় শব্দ, সেলফি তোলা বা অশালীন আচরণ থেকে বিরত থাকুন।
প্রসাদ নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও সময় অনুসরণ করুন।
মন্দিরে ভক্তদের জন্য প্রসাদ বিক্রেতা ও পূজা সামগ্রীর দোকান রয়েছে। নিজ দায়িত্বে সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে।
দানের জন্য মন্দিরের নির্ধারিত দানবাক্স ব্যবহার করুন।
পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে বিশ্রামাগার ও ছায়াযুক্ত বসার জায়গা, তবে বড় কোনো আবাসন সুবিধা নেই, তাই বরিশাল শহরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করাই শ্রেয়।
অতএব, পরিকল্পিতভাবে গেলে সুগন্ধা শক্তিপীঠ দর্শন আরও শান্তিপূর্ণ ও স্মরণীয় হয়ে উঠবে।
সুগন্ধা নদীর সঙ্গে সম্পর্ক
সুগন্ধা শক্তিপীঠের নামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত রয়েছে পাশেই বয়ে চলা সুগন্ধা নদী। এই নদীর তীরে মন্দিরটির অবস্থান এই স্থানটিকে আরও পবিত্র ও সৌন্দর্যময় করেছে। নদীর শান্ত স্রোত এবং তার তীরবর্তী সবুজ পরিবেশ মন্দিরের আধ্যাত্মিক আবহকে বিশেষভাবে প্রসারিত করে।
পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, এই নদীটি দেবী সুনন্দার স্নানকূপ হিসেবে বিবেচিত, যেখানে ভক্তরা পুণ্যস্নানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করেন। প্রতি পূর্ণিমা ও বিশেষ তিথিতে ভক্তরা এই নদীতে স্নান করে মন্দিরে পূজার জন্য আসেন।
সুগন্ধা নদীর তীরে বসে প্রকৃতির রূপে মগ্ন হয়ে আসলেই অনুভব করা যায় এই স্থানের আধ্যাত্মিক শান্তি ও শক্তি। স্থানীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রায়ও এই নদীর গুরুত্ব অপরিসীম, যা মন্দিরের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
মন্দিরে যাতায়াতের সহজ উপায়
সুগন্ধা শক্তিপীঠ দর্শনে আসার জন্য যাতায়াতের উপায়গুলো বেশ সুবিধাজনক এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহজেই পৌঁছানো যায়।
ঢাকা থেকে:
ঢাকা থেকে বরিশাল পর্যন্ত বাস বা ট্রেনের মাধ্যমে যাত্রা করে বরিশাল পৌঁছানো যায়। বরিশাল থেকে শিকারপুর যাওয়ার জন্য স্থানীয় বাস বা নৌপরিবহন ব্যবহৃত হয়। ঢাকা থেকে মোটামুটি ৭-৮ ঘণ্টার পথ।
বরিশাল থেকে:
বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে অবস্থিত শিকারপুরে পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় বাস, রিকশা, অটো বা নৌকা পাওয়া যায়। শিকারপুর থেকে মন্দিরটি খুব কাছেই, তাই স্থানীয় পরিবহন সুবিধা বেশ উন্নত।
অন্য জেলা থেকে:
বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা থেকে বরিশাল পর্যন্ত বাস বা ট্রেনে যাওয়া যায়, এরপর বরিশাল থেকে শিকারপুরের জন্য স্থানীয় পরিবহন নিতে হয়।
যাত্রার সময় বিশেষ উৎসব বা পূর্ণিমার দিনগুলিতে যানজট বা ভিড় এড়াতে ভোরে রওনা হওয়া উত্তম। যাত্রাপথের সৌন্দর্য ও নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার কারণে ভ্রমণটি অনেকটাই মনোরম ও শান্তিপূর্ণ হয়।
সুগন্ধা শক্তিপীঠে যাতায়াতের জন্য সঠিক পরিকল্পনা করে গেলে ভক্ত ও পর্যটকদের যাত্রা সহজ ও আরামদায়ক হয়।
সুগন্ধা শক্তিপীঠের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
সুগন্ধা শক্তিপীঠ হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। সতীপীঠ হিসেবে এর গুরুত্ব ব্যাপক, কারণ এটি দেবী সতীর নাক পতিত স্থানের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই কারণে এখানে আসা ভক্তরা গভীর আধ্যাত্মিক তৃপ্তি ও মুক্তির আশায় আসেন।
এখানে তন্ত্র ও শক্তিপূজার মাধ্যমে শরীর ও মনের রোগ, অশুভ শক্তি দূর করার প্রার্থনা করা হয়। অনেক ভক্ত বিশ্বাস করেন, মন্দিরের দেবী সুনন্দার আশীর্বাদে জীবনে সৌভাগ্য, শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে।
সুগন্ধা শক্তিপীঠ শুধুমাত্র একটি মন্দির নয়, এটি শক্তির উৎস, যা ভক্তদের জীবনে নতুন উদ্যম ও আধ্যাত্মিক শক্তি যোগায়। এ কারণেই এখানে বহু বছর ধরে নানারকম ব্রত, পূজা ও তপস্যা চলে আসছে।
এই শক্তিপীঠের আধ্যাত্মিক শক্তি ও ঐতিহ্যের জন্য এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং সারা উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এখানে আসেন তাদের জীবনে আশীর্বাদের জন্য।
স্থানীয় জনগণের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি
সুগন্ধা শক্তিপীঠের আশপাশের এলাকা ও শিকারপুর গ্রামের স্থানীয় জনগণের মধ্যে এই মন্দিরকে গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়। তারা বিশ্বাস করেন, মন্দিরটি শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থান নয়, বরং এটি তাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ।
স্থানীয়রা প্রতি বছর উৎসব ও নবরাত্রি পালনে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে তারা পণ্ডিতদের সহযোগিতায় দেবী সুনন্দার পূজা আয়োজন করেন। মন্দিরের আশেপাশে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতি পালিত হয়, যা এলাকার সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে।
এছাড়া, স্থানীয় লোককথা ও কুসুমকাহিনী মন্দিরের আধ্যাত্মিক মহিমা ও দেবী সুনন্দার চমৎকার গুণাবলী বর্ণনা করে। অনেক সময় মন্দিরের আশপাশে সঞ্চিত গ্রামবাংলার লোকসংগীত ও পূজার গান ভক্তদের মনে এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগায়।
সুগন্ধা শক্তিপীঠ কেবল ধর্মীয় স্থান নয়, এটি এলাকার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সমাজবদ্ধতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত।
আরও পড়ুন: ঊনকোটি পর্বত কোটি দেবতার ভূমি – জানুন এর ঐতিহ্য ও কাহিনী
আশেপাশের পর্যটন ও দর্শনীয় স্থান
সুগন্ধা শক্তিপীঠ ঘিরে থাকা এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মন্দিরটির নিকটবর্তী এলাকার সংস্কৃতি, নদী ও গ্রামীণ জীবন ভ্রমণকে করে আরও স্মরণীয়।
আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান:
সুগন্ধা নদী
মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুগন্ধা নদী তার শান্ত স্রোত ও সবুজ তীরবর্তী পরিবেশ দিয়ে দর্শনার্থীদের মন ভরে তোলে। নদীর ধারে বসে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
শিকারপুর গ্রাম
ঐতিহ্যবাহী গ্রামাঞ্চল হিসেবে শিকারপুর গ্রামের লোকজ সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও গ্রামীণ জীবন দর্শনের জন্য আকর্ষণীয়।
বরিশাল শহর
প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির কেন্দ্র বরিশাল শহর থেকে মন্দিরটি খুব কাছেই অবস্থিত। বরিশালে রয়েছে বাজার, মিউজিয়াম, নদীভ্রমণসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র।
কর্মকারণ মন্দির
বরিশালের আরও একটি প্রখ্যাত মন্দির, যা ধর্মীয় ভ্রমণকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
স্থানীয় হাট ও বাজার
শিকারপুর ও আশেপাশে বসে স্থানীয় হাট বাজার, যেখানে গ্রামীণ পণ্য, হস্তশিল্প ও খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়।
সুগন্ধা শক্তিপীঠ ভ্রমণের সঙ্গে এই সব দর্শনীয় স্থানগুলো যুক্ত করলে ভ্রমণটি হয়ে ওঠে পূর্ণাঙ্গ ও উপভোগ্য। যারা প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতা একসঙ্গে উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য এই এলাকা আদর্শ গন্তব্য।
ধর্মীয় গ্রন্থ ও বিশ্বাসের উল্লেখ
সুগন্ধা শক্তিপীঠের মাহাত্ম্য হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ ও পুরাণে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। শক্তিপীঠসমূহের তালিকায় এই মন্দিরের নাম বিশেষ গুরুত্বসহকারে এসেছে। পুরাণানুসারে, দেবী সতীর নাক এই স্থানে পতিত হওয়ায় এখানে দেবী সুনন্দার আরাধনা হয়।
স্কন্দ পুরাণ, শ্রীরামায়ণ ও অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে শক্তিপীঠের বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে সুগন্ধা শক্তিপীঠকে সতীপীঠগুলোর অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই মন্দিরের আধ্যাত্মিক শক্তিকে প্রমাণিত করতে নানা তন্ত্রশাস্ত্রেও এর উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এখানে পূজা ও তন্ত্রীয় আচরণ শরীর ও মনের অসুখ দূর করে, জীবনকে শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ করে। মন্দিরটির মাহাত্ম্য ও শক্তির প্রতি বিশ্বাস হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীরভাবে বিরাজ করে।
এই ধরনের ধর্মীয় গ্রন্থ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে সুগন্ধা শক্তিপীঠ একটি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত।
সুগন্ধা শক্তিপীঠের সামাজিক প্রভাব
সুগন্ধা শক্তিপীঠ কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন্দিরের আশেপাশে বসবাসকারী লোকজন এই পবিত্র স্থানকে তাদের ঐতিহ্য ও পরিচয়ের অংশ মনে করে।
প্রধান উৎসবগুলো যেমন শিবচতুর্দশী ও নবরাত্রির সময় স্থানীয় সমাজে একতার দৃশ্য দেখা যায়, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একত্রিত হয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে। এসব উৎসব স্থানীয় অর্থনীতি ও সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে।
মন্দিরের আয়োজনে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও দান কার্যক্রম হয়, যা দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এটি এলাকার উন্নয়নেও এক ভূমিকা রাখে।
পর্যটকদের আগমনে স্থানীয় ব্যবসায় ও হস্তশিল্পে ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে, যা এলাকার অর্থনৈতিক সজীবতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
সুগন্ধা শক্তিপীঠ শুধু আধ্যাত্মিক কেন্দ্রই নয়, এটি একটি সামাজিক সেতুবন্ধন, যা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
আরও পড়ুন: ভারতের আদি জ্যোতির্লিঙ্গ সোমনাথ মন্দিরের গুরুত্ব ও ধর্মীয় মাহাত্ম্য