ঊনকোটি পর্বত কোটি দেবতার ভূমি – জানুন এর ঐতিহ্য ও কাহিনী

পোস্ট টি ভালোলাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না

ঊনকোটি পর্বত কোটি দেবতার ভূমি

অবস্থান ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

ঊনকোটি পর্বত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার উত্তর ত্রিপুরা জেলায় অবস্থিত, প্রায় ১৭৮ কিলোমিটার দূরে রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে। এটি কৈলাসহর মহকুমার অন্তর্গত, যেখানে পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে আছে এক বিস্ময়কর ধর্মীয় ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।

ঊনকোটি অঞ্চলটি পাহাড়ী ভূখণ্ড হওয়ায় এখানকার দৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত  এখানকার সৌন্দর্যে বাড়তি আকর্ষণ যোগ করে। ত্রিপুরা ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (TTDC) ঊনকোটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

ঊনকোটি পর্বতের অবস্থান শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার পূণ্যার্থী ও পর্যটক ভ্রমণে আসেন।

ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব

ঊনকোটি পর্বতের ইতিহাস ঘিরে রয়েছে রহস্য, ধর্মীয় উপাখ্যান এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময়। গবেষকদের মতে, এটি খ্রিস্টপূর্ব ৭ম থেকে ৯ম শতাব্দীর মধ্যে গঠিত একটি শৈলশিল্প-ভিত্তিক ধর্মীয় কেন্দ্র, যার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হল শৈব ধর্ম, অর্থাৎ শিব উপাসনা।

এই পর্বতকে ঘিরে রয়েছে একটি জনপ্রিয় লোককথা, যেখানে বলা হয় — শিব একবার এক কোটি দেবতাকে নিয়ে কৈলাস যাত্রার উদ্দেশ্যে এখানে রাত্রি যাপন করেন। কিন্তু সকালে কেবল শিব জেগে ওঠেন, বাকিরা ঘুমিয়ে থাকেন। এতে রুষ্ট হয়ে শিব বাকিদের অভিশাপ দেন এবং সবাইকে পাথরে পরিণত করেন। সেই এক কোটি দেবতাদের পাথরের মূর্তিই নাকি আজকের ঊনকোটি — তবে খুঁজে পাওয়া গেছে প্রায় ৯৯,৯৯৯৯টি, অর্থাৎ ঠিক এক কোটি নয় — তাই নাম “ঊনকোটি” (এক কোটি থেকে এক কম)।

এই কিংবদন্তির পাশাপাশি, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান বলছে, এখানকার শিলালিপি ও খোদাই শিল্প বিশাল পরিসরে ছড়ানো। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর বিশাল আকৃতির মূর্তি ও প্রতিকৃতি যেমন শিব, গণেশ, পার্বতী, বিষ্ণু ইত্যাদি এখানে খোদাই করা হয়েছে পাহাড়ের গায়ে — যেগুলো ভারতবর্ষের প্রাচীন শৈলশিল্পের অন্যতম নিদর্শন।

ঊনকোটি শুধু একটি পূণ্যস্থান নয় — এটি ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক হেরিটেজ সাইট, যেটি আজও গবেষক ও ঐতিহাসিকদের বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয়।

 শিলালিপি ও খোদাই  হিন্দু দেবদেবীর মহাকাব্যিক রূপ

ঊনকোটি পর্বতের সবচেয়ে চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয় দিক হলো এখানকার পাথরে খোদাই করা বিশালাকৃতি মূর্তি ও প্রতীক। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে শিব, পার্বতী, গণেশ, কার্তিকেয়, বিষ্ণু, হনুমানসহ বহু হিন্দু দেবদেবীর চিত্র — যেগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনন্য।

সবচেয়ে বিখ্যাত খোদাইটি হলো “উনকোটি শিবমূর্তি”, যেটি প্রায় ৩০ ফুট লম্বা। এই প্রতিমার চারপাশে দেখা যায় একাধিক ছোট ছোট দেবতাদের মুখাবয়ব। শিবের মাথার ওপর দেখা যায় একটি রাজমুকুটের মতো খোদাই যা ‘মুকুটেশ্বর শিব’ নামে পরিচিত। এই ধরনের কাজ প্রমাণ করে প্রাচীনকালে এখানে হিন্দু ধর্মের বিশাল উপস্থিতি এবং শৈলশিল্পের অগ্রগতি।

পাথরে খোদাইয়ের পাশাপাশি এখানে কিছু পাথরের তৈরি স্থাপত্যের চিহ্নও পাওয়া যায় — যেমন শিবলিঙ্গ, যজ্ঞ কুণ্ড, নন্দীর মূর্তি প্রভৃতি। এসব শিলালিপি ও খোদাই কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং তৎকালীন সমাজের শিল্প, সংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্বের ধারক।

এই প্রতিমাগুলোর নিখুঁত কারুকাজ দেখে ধারণা করা হয়, স্থানীয় রাজা বা শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষ শিল্পীরা এগুলি তৈরি করেছিলেন ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এবং শৈব সম্প্রদায়ের সাধনায় ব্যবহৃত হতো।

ঊনকোটির এই শিলালিপি ও খোদাইকর্ম ভারতের শৈলশিল্পের ইতিহাসে একটি অসাধারণ অধ্যায় রচনা করেছে।

 হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ঊনকোটি পর্বতের সম্পর্ক

ঊনকোটি পর্বত কেবল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, এটি হিন্দু ধর্মের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত একটি পবিত্র তীর্থস্থান। এখানকার প্রতিটি খোদাই, প্রতিমা ও প্রতীক হিন্দু ধর্মের প্রধান দেবদেবীর উপাসনার নিদর্শন বহন করে। এই পর্বতের কেন্দ্রে রয়েছে শিব — যাঁকে এখানে ‘মুকুটেশ্বর শিব’ নামে অভিহিত করা হয়।

পুরাণ অনুসারে, শিব কৈলাস যাত্রার পথে এক কোটি দেবতাকে নিয়ে এখানে রাত যাপন করেন। কিন্তু পরদিন সকলে ঘুম থেকে না ওঠায় শিব তাঁদের অভিশাপ দিয়ে পাথরে পরিণত করেন। এই এক কোটি মূর্তির মধ্য থেকে মাত্র একশো অদৃশ্য থাকায় স্থানটির নাম হয় ঊনকোটি (অর্থাৎ, ‘এক কোটি থেকে এক কম’)।

শৈব ধর্মের অনুগামীদের জন্য এটি একটি শক্তিপীঠসদৃশ স্থান, যেখানে শিবলিঙ্গ, ত্রিশূল, ডমরু, নন্দী প্রভৃতি উপাসনার প্রতীক পাওয়া যায়। তাছাড়াও বিষ্ণু, গজানন (গণেশ), কার্তিকেয়, পার্বতী ও হনুমান প্রভৃতি দেবতার খোদাই পাওয়া যায়, যা হিন্দু ধর্মের বহুমুখী উপাসনার চিত্র তুলে ধরে।

স্থানীয় মানুষ এখনও ঊনকোটিকে অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে মানে এবং সেখানে প্রতি বছর “আশ্বিন সংক্রান্তি” এবং “মাঘ সংক্রান্তি” উপলক্ষে হাজার হাজার হিন্দু পুণ্যার্থী পূজা ও স্নানের জন্য সমবেত হন।

এইভাবে ঊনকোটি পর্বত শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, বরং হিন্দু ধর্মের ইতিহাস ও সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল।

 ধর্মীয় উপাখ্যান ও লোককথা

ঊনকোটি পর্বতের মাহাত্ম্য শুধুমাত্র তার শৈলশিল্প বা ধর্মীয় স্থাপত্যে সীমাবদ্ধ নয় — বরং এর চারপাশে আবর্তিত হয় শত শত বছরের পুরোনো ধর্মীয় উপাখ্যান ও লোককথা, যা স্থানটির আধ্যাত্মিক মহিমাকে আরও গভীর করে তোলে।

ত্রিপুরার লোকমুখে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় পুরাণ-ভিত্তিক উপাখ্যানে বলা হয় —
শিব মহাদেব কৈলাস যাত্রার জন্য এক কোটি দেবতাকে সঙ্গে নিয়ে এই স্থানে রাত্রী যাপন করেন। তিনি সবাইকে ভোরে উঠে কৈলাসযাত্রার প্রস্তুতি নিতে বলেন। কিন্তু সকালে কেবল শিব নিজেই জাগেন, আর অন্য দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। এতে শিব রুষ্ট হয়ে তাঁদের অভিশাপ দেন এবং সকলকে পাথরে পরিণত করেন। সেই পাথরের রূপান্তরিত দেবতাদের খোদাই ও মূর্তিগুলোকেই আজ আমরা ঊনকোটি পর্বতে দেখতে পাই।

এই কাহিনি থেকেই আসে ‘ঊনকোটি’ নামের উৎস — অর্থাৎ এক কোটি থেকে একটি কম (যেহেতু শিব নিজে ছিলেন জাগ্রত)। এই কাহিনিটি শৈব মতাবলম্বীদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক বিশ্বাসের সঙ্গে এই স্থানের একটি গভীর যোগসূত্র তৈরি করে।

এছাড়াও, স্থানীয়দের মধ্যে আরও কিছু লোককথা প্রচলিত রয়েছে, যেখানে বলা হয় এখানে এক সময়ে তপস্যা করতেন শিবভক্ত এক সিদ্ধ পুরুষ বা সাধু, যাঁর কল্পনাশক্তিতেই এসব দেবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছিল। এই কিংবদন্তিগুলো ঊনকোটিকে শুধু একটি ইতিহাস নয়, বরং আধ্যাত্মিক প্রেরণার উৎসে পরিণত করেছে।

এই সব উপাখ্যান ও লোককাহিনির ভিত্তিতে ঊনকোটি পর্বত স্থানীয় ও বহিরাগত হিন্দু ভক্তদের কাছে আজও এক অলৌকিক, দেবসমৃদ্ধ এবং পূণ্যতীর্থ হিসেবে স্বীকৃত।

 শৈব উপাসনার এক অন্যতম প্রাচীন কেন্দ্র

ঊনকোটি পর্বত ইতিহাসে ও ধর্মে একটি শক্তিশালী শৈব তীর্থস্থান হিসেবে চিহ্নিত। এই স্থানটি হিন্দু ধর্মের শৈব সম্প্রদায়–এর উপাসনাস্থল হিসেবে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচিত। এখানে শিবের উপস্থিতি এবং মহিমা সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে — প্রতিটি শিলালিপি, খোদাই, এবং দেবমূর্তিতে শিবতত্ত্বেরই প্রকাশ।

এই পর্বতের কেন্দ্রীয় আকর্ষণ হল বিশাল আকারের মুকুটেশ্বর শিবমূর্তি (প্রায় ৩০ ফুট লম্বা), যার পাশে নন্দী ও অন্যান্য উপাস্য প্রতীক খোদাই করা হয়েছে। এটি যে কোনও শৈব উপাসকের জন্য একটি অলৌকিক অভিজ্ঞতা।

এছাড়াও পর্বতের গায়ে খোদাই করা ত্রিশূল, ডমরু, শিবলিঙ্গ, ও জটাজুটধারী শিবরূপ — এগুলো প্রমাণ করে যে ঊনকোটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শৈব আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ছিল, যেখানে দেবতাকে নিত্যপূজা ও তপস্যা করা হতো।

প্রতিবছর মাঘ সংক্রান্তি এবং আশ্বিন সংক্রান্তি উপলক্ষে এখানে বিশাল শিব পূজা ও তীর্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে হাজার হাজার শৈব ভক্ত যোগ দেন। এই উৎসবগুলি এই অঞ্চলের শৈব ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক।

ঊনকোটি পর্বত, এই দিক থেকে, শুধু ইতিহাসের নয় — শিবের এক জীবন্ত উপাসনাস্থান হিসেবে আজও পূজিত হয়ে আসছে।

দেবমূর্তির বৈচিত্র্য ও প্রাচীন শিল্পশৈলী

ঊনকোটি পর্বতের সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো এখানকার দেবমূর্তির বৈচিত্র্য ও শৈল্পিক উৎকর্ষতা। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা মূর্তিগুলোর মধ্যে শুধু শিবই নন, বরং হিন্দু ধর্মের একাধিক দেবতা ও দেবীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যা এই স্থানকে একটি বহুমুখী দেবস্থান রূপে চিহ্নিত করে।

প্রধান মূর্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • মুকুটেশ্বর শিব: বিশাল আকৃতির মুখমণ্ডল ও অলঙ্কারসহ শিবের এক রাজসিক রূপ।
  • গণেশ মূর্তি: একাধিক স্থানে গণেশের অনন্য ভঙ্গিমায় খোদাইকৃত মূর্তি দেখা যায়।
  • উমা-সহিত শিব: শিব ও পার্বতীর যুগল মূর্তি, যা তান্ত্রিক ও শৈব উপাসনার এক নিদর্শন।
  • বিষ্ণু ও তাঁর অবতার: কিছু অংশে বিষ্ণুর অনুপ্রেরণামূলক খোদাইকর্ম পাওয়া গেছে।
  • কার্তিকেয় ও হনুমান: শক্তির প্রতীক হিসেবে এদের উপস্থিতি পর্বতের ধর্মীয় গুরুত্বকে আরও বিস্তৃত করে। 

এই খোদাইকর্মে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, প্রাচীন শিল্পীরা শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যেই নয় বরং অসাধারণ কারিগরি দক্ষতা নিয়েই এই মূর্তিগুলো তৈরি করেছিলেন।
শৈলশিল্পে ব্যবহৃত শৈলী ও অলংকারের সূক্ষ্মতা দেখে গবেষকরা মনে করেন এটি ৮ম–৯ম শতাব্দীর পাল যুগ বা তারও পূর্ববর্তী সময়ের হতে পারে।

এই দেবমূর্তিগুলো শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং ভারতের প্রাচীন ভাস্কর্যশিল্পের গৌরবময় পরিচয় বহন করে। ফলে, ঊনকোটি শুধুই পূজার স্থান নয় — এটি একটি খোলা আকাশের নিচের “প্রাচীন শিল্পগ্যালারি”।

স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চর্চার কেন্দ্র

ঊনকোটি পর্বত শুধু একটি প্রাচীন ধর্মীয় স্থান নয়, এটি ত্রিপুরার স্থানীয় জনগণের জীবনে ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানান আচার-অনুষ্ঠান, লোকজ বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

ত্রিপুরার আদিবাসী ও হিন্দু জনগোষ্ঠী ঊনকোটিকে “জাগ্রত তীর্থস্থান” বলে মনে করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এখানে প্রার্থনা করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। তাই প্রতিদিন স্থানীয়রা এখানে গিয়ে জল, ফুল, ধূপ জ্বালিয়ে শিবের আরাধনা করে।

প্রতিবছর দুটি বিশেষ উৎসবে —

  • আশ্বিন সংক্রান্তি
  • মাঘ সংক্রান্তি
    এখানে ব্যাপক ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা এবং মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার পুণ্যার্থী, সাধক ও পর্যটক এখানে ভিড় করেন। মেলায় স্থানীয় হস্তশিল্প, লোকগান, নৃত্য ও ধর্মীয় নাটকের মাধ্যমে ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

এছাড়া, ঊনকোটি ঘিরে প্রচলিত লোককথা, শিবের উপাখ্যান, ও ধর্মীয় কাহিনিগুলো লোকসংগীত ও লোককথার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে।

এইভাবে, ঊনকোটি পর্বত শুধু একটি ধর্মীয় বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয় — এটি ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক পরিচয় ও আধ্যাত্মিক চেতনার কেন্দ্রবিন্দু।

 ঊনকোটি মেলা ও পূর্ণিমার তীর্থযাত্রা

ঊনকোটি পর্বতের অন্যতম বড় ধর্মীয় আকর্ষণ হল এখানকার বার্ষিক মেলা ও পূর্ণিমার তীর্থযাত্রা, যা স্থানীয়ভাবে “ঊনকোটি মেলা” নামে পরিচিত। এটি মূলত দুইটি বড় ধর্মীয় উৎসব ঘিরে অনুষ্ঠিত হয়:

  1. আশ্বিন সংক্রান্তি
  2. মাঘ সংক্রান্তি 

এই সময় ঊনকোটি পর্বত পরিণত হয় হাজার হাজার শিবভক্ত, সাধু-সন্ন্যাসী, তীর্থযাত্রী ও পর্যটকের মিলনমেলায়। তারা এখানে এসে স্নান করেন, শিবের আরাধনা করেন, এবং ধর্মীয় উৎসব পালন করেন। পর্বতের পাদদেশে প্রাকৃতিক ঝর্ণার জলে পুণ্যস্নান, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে পূজা অর্চনার মাধ্যমে তীর্থযাত্রার রীতি সম্পন্ন করা হয়।

ঊনকোটি মেলায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও অনুষ্ঠিত হয়:

  • লোকসংগীত ও ধর্মীয় কীর্তন
  • হস্তশিল্প ও স্থানীয় পণ্যের দোকান
  • আধ্যাত্মিক আলোচনা সভা
  • ভক্তিমূলক নাটক ও পথনাট্য 

এই মেলা শুধু ধর্মীয় উদ্দেশ্যেই নয়, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং পর্যটনের বিকাশেও বড় ভূমিকা রাখে। রাজ্য সরকার ও পর্যটন দপ্তরও এই মেলাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

ঊনকোটি মেলা আজ শুধু ত্রিপুরার নয়, সমগ্র পূর্বভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শৈব তীর্থোৎসব হিসেবে পরিচিত, যা হিন্দু ধর্মের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক।

 প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ

ঊনকোটি পর্বত তার ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও বিখ্যাত। ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত এই স্থানটি ঘেরা আছে ঘন বনভূমি ও পাহাড়ের সবুজ শোভায়। চারদিকে প্রকৃতির নৈসর্গিক ছোঁয়া এই পবিত্র স্থানটিকে আরও রহস্যময় ও আকর্ষণীয় করে তোলে।

পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত ঊনকোটি ঝর্ণা পর্যটক ও ধর্মীয় ভক্তদের জন্য এক প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল। ঝর্ণার স্নিগ্ধ জলরাশির শব্দ ও ঠান্ডা বাতাস ভ্রমণকে করে তোলে আরও মনোরম ও প্রাণবন্ত।

ঊনকোটির চারপাশের বনজঙ্গল বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। প্রকৃতিপ্রেমী ও বন্যজীবন অনুরাগীরা এখানে বিশেষ আগ্রহ নিয়ে আসেন।

এছাড়া, ঊনকোটি পর্বতের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা ও সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পর্যটকদের জন্য নির্মিত হেঁটে যাওয়ার পথ, পর্যবেক্ষণ পয়েন্ট ও তথ্যকেন্দ্র রয়েছে যাতে তারা নিরাপদ ও সুষ্ঠুভাবে এই প্রকৃতি উপভোগ করতে পারেন।

প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের সমন্বয়ে ঊনকোটি পর্বত হয়ে উঠেছে ত্রিপুরার অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান।

 পর্যটন উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা

ঊনকোটি পর্বত ত্রিপুরার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার কারণে রাজ্য সরকার এবং পর্যটন দপ্তর এই এলাকায় পর্যটন উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এর ফলে পর্যটকদের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।

সরকারি পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীদের জন্য নির্মিত হয়েছে পরিষ্কার হেঁটে যাওয়ার পথ, বিশ্রামাগার, পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং তথ্যকক্ষ, যেখানে ঊনকোটি পর্বতের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। পর্যটকদের জন্য স্থানীয় খাদ্য, হস্তশিল্প ও স্মারক সামগ্রীর দোকান রয়েছে।

পর্যটন বাড়াতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে — আগরতলা থেকে ঊনকোটি পর্যন্ত সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করা হয়েছে। ফলে ভ্রমণ আরও সহজ ও আরামদায়ক হয়েছে।

বিশেষ করে আশ্বিন ও মাঘ মাসের উৎসবকালীন সময়ে পর্যটকদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প ও পুণ্যস্নানের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাও করা হয়। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে নিয়মিত তদারকি করে।

এই উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে ঊনকোটি পর্বতকে একটি আধুনিক, স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং নিরাপদ ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক ভ্রমণস্থল হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।

 স্থানীয় জনগণের ভূমিকা ও সহযোগিতা

ঊনকোটি পর্বতের সুরক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষায় স্থানীয় জনগণের অবদান অপরিসীম। ত্রিপুরার স্থানীয় আদিবাসী ও হিন্দু সম্প্রদায় এই পবিত্র স্থানটিকে নিজেদের প্রাণের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে আসছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর পবিত্রতা ও গুরুত্ব রক্ষা করে চলেছে।

স্থানীয়রা নিয়মিতভাবে ঊনকোটি পর্বতের চারপাশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে এবং ধর্মীয় উৎসব ও পূজার আয়োজন করে। তারা মেলা ও তীর্থযাত্রার সময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে স্থানীয়রা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ঐতিহ্যের মূল্য সম্পর্কে সচেতন হয়েছে, যা ভবিষ্যতে এই স্থানের ধ্বংস রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

পর্যটকদের জন্য তারা আতিথেয়তা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, যা স্থানীয় পর্যটন ও অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।

এই সকল উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ ঊনকোটি পর্বতের একটি টেকসই ও সম্মানজনক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

 ঊনকোটি পর্বতের বৈশ্বিক গুরুত্ব

ঊনকোটি পর্বত শুধু ত্রিপুরা বা ভারতের সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিশ্বের প্রাচীন ধর্মীয় ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যে একটি অনন্য নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। এর বিশাল শিলালিপি ও খোদাইকৃত দেবমূর্তি গুলো প্রাচীন হিন্দু শৈলশিল্পের উৎকর্ষতার আন্তর্জাতিক উদাহরণ।

গবেষক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা ঊনকোতিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য সুপারিশ করেছেন, কারণ এটি প্রাচীন শৈব ধর্মের মূর্তি ও শৈলশিল্পের এক অভূতপূর্ব সংগ্রহস্থল। এর শিল্পকলা ও ধর্মীয় দিক থেকে তুলনামূলকভাবে অন্য দেশের প্রাচীন পাথরের খোদাইকর্মের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।

বিশ্ব পর্যটকদের মধ্যে হিন্দুধর্মের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায়, ঊনকোটি পর্বত আন্তর্জাতিক পর্যটন ও আধ্যাত্মিক ভ্রমণের একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে উদীয়মান।

এছাড়া, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এই স্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।

সুতরাং, ঊনকোটি পর্বত কেবল একটি জাতীয় বা আঞ্চলিক ঐতিহ্য নয়, বরং বিশ্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক গৌরবময় অংশ।

 সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ঊনকোটি পর্বতের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় এবং পর্যটন উন্নয়নের পাশাপাশি এই স্থানটির সংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ত্রিপুরা সরকার ও ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর মিলে এই শৈলশিল্প ও শিলালিপির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

সংরক্ষণ কর্মসূচির আওতায় প্রাচীন মূর্তি ও খোদাইকৃত অংশগুলোতে ক্ষয়ক্ষতি রোধে বিশেষ প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট পথ ও নির্দেশিকা স্থাপন করা হয়েছে যাতে এই স্থানের ভাঙচুর বা অবক্ষয় রোধ করা যায়।

এছাড়া, স্থানীয় জনগণ ও ভক্তদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মশালা ও সভার আয়োজন করা হচ্ছে, যাতে তারা ঐতিহ্য সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেন।

ভবিষ্যতে পর্যটন বৃদ্ধি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আরও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হোস্টেল, বিশ্রামাগার, তথ্যকেন্দ্র এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

এই সকল পরিকল্পনা ও সংরক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ঊনকোটি পর্বতকে একটি টেকসই, পবিত্র ও পর্যটকদের জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্যও ঐতিহ্যবাহী গুরুত্ব বহন করবে।

 সারাংশ ও ঊনকোটি পর্বতের গুরুত্ব

ঊনকোটি পর্বত শুধুমাত্র ত্রিপুরার একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, এটি হিন্দু ধর্মের শৈব উপাসনার একটি অমূল্য কেন্দ্র ও প্রাচীন শিল্পকলা ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। এখানে খোদাইকৃত এক কোটি শিলালিপি ও বিশাল মূর্তির মধ্যে শিব ও অন্যান্য দেবতাদের এক অনন্য শিল্পসংগ্রহ পাওয়া যায়, যা ভারতীয় ইতিহাস ও ধর্মের অঙ্গ।

এটি স্থানীয় জনগণের বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, মেলা ও পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ঊনকোটি শুধুমাত্র অতীতের নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান এবং পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে।

রাজ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টায় এই স্থানটির সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করছে।

সুতরাং, ঊনকোটি পর্বত ভারতের ঐতিহ্যবাহী ও ধর্মীয় ইতিহাসে এক স্বর্ণালী অধ্যায় এবং এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।

ঊনকোটি পর্বত কেবল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, এটি হিন্দু ধর্মের শৈব উপাসনার এক পবিত্র তীর্থস্থান এবং প্রাচীন শিল্পকলার এক অসাধারণ নিদর্শন। এখানে খোদাইকৃত দেবমূর্তি ও শিলালিপিগুলো প্রাচীন ভারতের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের গভীর প্রতিফলন।

স্থানীয় জনগণ, রাজ্য সরকার ও প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের যৌথ প্রচেষ্টায় ঊনকোটি পর্বতের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন চলছে, যা এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটিকে আধুনিক যুগেও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করছে। প্রতি বছর হাজার হাজার ধর্মীয় ভক্ত ও পর্যটক এখানে এসে আধ্যাত্মিক সান্ত্বনা ও ঐতিহাসিক ঐভব উপভোগ করেন।

সুতরাং, ঊনকোটি পর্বত শুধু ত্রিপুরার নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য এক অনন্য সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পদ, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ ও প্রসারে আমাদের সকলের সচেতনতা ও সহায়তা অপরিহার্য।

আরো পড়ুন : নাগ পঞ্চমী পূর্ণ বিবরণ , ইতিহাস, তিথি, পূজা বিধি ও লোককথা
পোস্ট টি ভালোলাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না 🙏