মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা
পূজার গুরুত্ব, ঐতিহ্য ও প্রাসঙ্গিকতা
বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মজিলা রাজবাড়ি দুর্গাপূজা। এটি কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং একটি সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং আত্মিক মিলনের অনুষ্ঠান। প্রতিটি অঞ্চলের পূজার রয়েছে নিজস্ব রীতিনীতি, সৌন্দর্য ও বিশেষত্ব, যা একটি বিশেষ পরিচিতি বহন করে। ঠিক তেমনি, রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার অন্তর্গত মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ধারক, যা আজও ধর্মীয় ভক্তি, সংস্কৃতি এবং সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন।
প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলে আসা এই পূজা রাজবাড়ির আভিজাত্য, স্থানীয় জনমানুষের আবেগ এবং বাঙালির ধর্মীয় অনুভূতির মিলিত রূপ। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও এই পূজায় আজও অনুভব করা যায় পুরনো দিনের সেই আচার-অনুষ্ঠান, সনাতনী পরিবেশ ও ঐতিহ্যের গাম্ভীর্য। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাই এখন সময়ের দাবি।
মজিলা রাজবাড়ির ইতিহাস: রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা ও জমিদার ঐতিহ্য
রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার অন্তর্গত মজিলা গ্রামে অবস্থিত মজিলা রাজবাড়ি এক সময়ের জমিদার শাসনের গৌরবময় ইতিহাস বহন করে। এই রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, যখন জমিদার ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন কিছু অভিজাত হিন্দু পরিবার। মজিলা অঞ্চলের জমিদাররা ছিলেন শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান এবং ধর্মপ্রাণ। তাঁদের অবদানে শুধু মন্দির বা স্থাপত্যই নয়, গড়ে উঠেছিল সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি।
মজিলা রাজবাড়ি ছিল এক সময় এলাকার কেন্দ্রবিন্দু—যেখান থেকে শাসন, ধর্মীয় আয়োজন এবং সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। রাজবাড়ির স্থাপত্যে মোগল ও ইউরোপীয় প্রভাবের ছাপ দেখা যায়, যা ঐ সময়কার বাংলার রাজবাড়ির বৈশিষ্ট্য বহন করে। রাজপরিবার দুর্গাপূজাকে শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব হিসেবে নয়, বরং ‘রাজধর্ম’ রূপে পালন করতেন—যাতে প্রজাদের অংশগ্রহণ, আনন্দ ও ভক্তি একই সঙ্গে মিলিত হতো।
এই রাজবাড়ির প্রাচীন দেয়াল, অলংকৃত প্রবেশদ্বার এবং পূজামণ্ডপ আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও কালের প্রবাহে জমিদার ব্যবস্থার অবসান হয়েছে, তবুও মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা আজও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে টিকে আছে।
দুর্গাপূজার সূচনা: কবে, কারা শুরু করে, প্রাচীনতা
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজার সূচনা ঘটে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। পূজার প্রবর্তক ছিলেন তৎকালীন মজিলা রাজপরিবারের জমিদার রামকান্ত রায়চৌধুরী, যিনি ছিলেন এক ধর্মপরায়ণ ও সংস্কৃতিমনস্ক শাসক। রাজপরিবারের তত্ত্বাবধানে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হয় মূল রাজবাড়ির অঙ্গনেই, যেখানে রীতি মেনে গড়ে তোলা হতো মাটির প্রতিমা ও কাঠের মণ্ডপ।
প্রথমদিকের পূজা ছিল একান্তই রাজপরিবারকেন্দ্রিক, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি স্থানীয় জনগণের সর্বজনীন উৎসবে রূপ নেয়। রাজারা এই পূজাকে শুধু পারিবারিক ধর্মীয় অনুশীলন হিসেবে দেখেননি, বরং সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং রাজধর্ম হিসেবে পালন করতেন, যাতে প্রজারা পূর্ণ সম্মান ও উৎসাহ নিয়ে অংশ নিতে পারেন।
এই পূজার ইতিহাসে দেখা যায়—প্রতিবার পূজার আগে রাজপরিবার নিজ হাতে জমি থেকে কুমার পাড়া পর্যন্ত কাঁচামাল পৌঁছে দিতেন, এবং পূজার প্রতিমা নির্মাণ, অনুষ্টান ও প্রসাদ বিতরণে নিখুঁত তদারকি করতেন। সেই সময়কার ‘পাঁচালি পাঠ’, চণ্ডীপাঠ, ধুনুচি নৃত্য এবং ঢাকের সুর আজও পূজার অন্যতম আকর্ষণ।
এভাবে মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রক্ষিত হয়ে আসছে।
রাজপরিবারের ভূমিকা : রাজাদের আনুষ্ঠানিকতা ও আচার
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজায় রাজপরিবারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক। এই পূজাকে কেন্দ্র করে রাজারা পালন করতেন একাধিক আনুষ্ঠানিকতা ও ধর্মীয় আচার, যা কেবল ধর্মাচরণ নয়, বরং একটি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবেও বিবেচিত হতো।
প্রথম থেকেই পূজার ব্যয়ভার বহন, প্রতিমা নির্মাণে দিকনির্দেশনা, পুজো পরিচালনার জন্য পুরোহিত নিয়োগ, এমনকি অনুষ্ঠানের সময় প্রজাদের আপ্যায়নের মতো সবকিছুই রাজারা ব্যক্তিগতভাবে তদারকি করতেন। ষষ্ঠীর দিন রাজা নিজ হাতে পূজামণ্ডপে উপস্থিত থেকে কলাবৌ স্থাপন করতেন এবং পরে পূজার মূল আয়োজন শুরু হতো।
প্রতিদিন পূজার সময় রাজপরিবারের সদস্যরা নির্ধারিত পোশাক পরে আরতি, অঞ্জলি ও সন্ধিপূজায় অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষ করে অষ্টমীর সন্ধিপূজা ও নবমীর কুমারী পূজা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আচার, যেখানে রাজা ও রানি স্বহস্তে কুমারীকে পূজা করতেন এবং আশীর্বাদ গ্রহণ করতেন।
রাজবাড়ির নারীরা দুর্গা প্রতিমাকে সাজিয়ে তুলতেন শোলা, রেশমি কাপড়, এবং ঐতিহ্যবাহী গয়নায়। দশমীর দিন বিসর্জনের আগে রাজার নিজ হাতে সিঁদুর খেলা শুরু করা ও স্নানযাত্রা ছিল এক ঐতিহাসিক দৃশ্য। রাজা নিজে শোভাযাত্রায় অংশ নিতেন, আর প্রজারা তাকে দেখতে ছুটে আসতেন দূর-দূরান্ত থেকে।
এই সকল আচার-আনুষ্ঠানিকতায় রাজাদের অংশগ্রহণ মজিলা দুর্গাপূজাকে কেবল এক ধর্মীয় উৎসব না রেখে, এক রাজকীয় ঐতিহ্য ও জনসম্পৃক্ত সামাজিক উৎসব হিসেবে গড়ে তোলে।
পূজার স্থান ও স্থাপত্য: রাজবাড়ির অন্দরমহল, মণ্ডপ, পুরাতন কাঠামো
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও ঐতিহাসিক দিকগুলোর একটি হলো এর পূজার স্থান ও স্থাপত্যশৈলী। রাজবাড়ির অন্দরমহলের মধ্যে স্থাপিত পূজামণ্ডপটি একটি স্থায়ী কাঠামো, যা বহু প্রজন্ম ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। মণ্ডপটি এমনভাবে নির্মিত, যেন তা রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্যকে বহন করে, এবং একইসঙ্গে পূজার ধর্মীয় পরিবেশ বজায় রাখে।
মণ্ডপটি মূলত লাল ইট, চুন, সুরকি এবং কাঠের নিখুঁত কারুকাজে নির্মিত। এর ছাদে আছে টেরাকোটার নকশা এবং প্রাচীন কালের হিন্দু পৌরাণিক গল্পের দৃশ্য। প্রবেশপথে খিলানযুক্ত দরজা, কর্নারে স্তম্ভ, আর ছাদে অলংকৃত কারুকাজ — সব মিলিয়ে এটি এক অপূর্ব ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন।
অন্দরমহলের এই মণ্ডপকে ঘিরে আছে বিশাল খোলা উঠোন, যেখানে বসানো হয় দর্শনার্থীদের আসন, ঢাকিদের জায়গা, এবং ধুনুচি নাচের মঞ্চ। একসময় এখানে রাজপরিবারের সদস্য ও অতিথিরা নির্ধারিত আসনে বসতেন, এবং সাধারণ প্রজারা রাজপ্রাসাদের বাইরে থেকেও পূজার মহিমা উপভোগ করতেন।
প্রতিমা স্থাপনের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটি হয় মণ্ডপের কেন্দ্রে, যেটি তুলনামূলকভাবে উঁচু মঞ্চের মতো। এই স্থান বিশেষভাবে পাকা মেঝে ও ফুল-আলংকৃত ছাদ দিয়ে সজ্জিত। সেখান থেকেই পূজার চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি, আরতি ইত্যাদি পরিচালিত হয়।
আজও এই প্রাচীন কাঠামো অনেকাংশে সংরক্ষিত আছে, যা মজিলা দুর্গাপূজাকে অন্য যেকোনো সাধারণ পূজা থেকে আলাদা করে তোলে। এই স্থাপত্য শুধু স্থানের সৌন্দর্যই নয়, বরং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবন্ত সাক্ষ্য।
প্রতিমা নির্মাণ ও শিল্পশৈলী: কিভাবে, কারা, কী ধরনের অলংকার ব্যবহার
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজায় প্রতিমা নির্মাণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ও ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়া, যা বহু প্রজন্ম ধরে অনুসৃত হয়ে আসছে। প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয় ভাদ্র মাসের শেষদিকে বা আশ্বিনের শুরুতে, এবং এটি সম্পূর্ণরূপে স্থানীয় কুমোরপাড়ার দক্ষ মৃৎশিল্পীদের হাতে গড়ে ওঠে।
প্রতিমা তৈরির মূল উপকরণ হলো—খড়, মাটি, শোলা, বাঁশ ও আঠা। প্রথমে বাঁশ ও খড় দিয়ে কাঠামো তৈরি করা হয়, এরপর মাটি দিয়ে ধাপে ধাপে গঠন করা হয় দেবী দুর্গা ও অন্যান্য দেব-দেবীর অবয়ব। প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হয় নির্দিষ্ট আচার মেনে এবং অত্যন্ত ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে।
দেবী দুর্গা এখানে পূজিত হন মহিষমর্দিনী রূপে—দশ হাতে অস্ত্রসহ, সিংহবাহিনী, এবং পায়ে মহিষাসুরকে পদদলিত অবস্থায়। সঙ্গে থাকেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। প্রতিমার মুখাবয়ব ও চোখ আঁকার সময় বিশেষ দিন (চক্ষুদান) অনুসরণ করা হয়, যা পূজার অন্যতম পবিত্র মুহূর্ত।
অলংকার ও সাজসজ্জার দিক থেকেও মজিলা রাজবাড়ির প্রতিমা অত্যন্ত রাজকীয় ও ঐতিহ্যবাহী। অলংকার তৈরি হয়—
- শোলা, কাপড়, সোনালি পেপার ও পুঁতির কাজে,
- মাথায় থাকে মুকুট, হাতে থাকে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, ধনুক-বাণ ইত্যাদি,
- পোশাকে ব্যবহৃত হয় রেশমি কাপড়, চুড়ি, গলায় মালা ও বাহারি গহনা।
বিশেষভাবে তৈরি হয় প্রতিমার পেছনে থাকা চৌখোপ বা পট, যা দেবীকে ঘিরে একটি আভিজাত্যপূর্ণ আবহ তৈরি করে।
এই শিল্পশৈলী শুধুমাত্র এক ধর্মীয় ভাস্কর্য নয়, বরং এটি গ্রামীণ শিল্প, ঐতিহ্য এবং রাজবাড়ির রুচিবোধের মিলিত রূপ, যা মজিলা দুর্গাপূজাকে একটি জীবন্ত লোকশিল্পের প্রদর্শনীতে রূপ দেয়।
পূজার সময় ও ধাপ: ষষ্ঠী থেকে দশমী, নির্দিষ্ট আচার
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা পালিত হয় সনাতন নিয়ম মেনে, ষষ্ঠী তিথি থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত পাঁচদিনব্যাপী মহা আড়ম্বরে। প্রতিটি দিন নির্দিষ্ট আচার ও ধর্মীয় বিধান অনুসারে পালন করা হয়, যেখানে পূজার গাম্ভীর্য এবং উৎসবের আমেজ একত্রে অনুভব করা যায়।
🗓 ষষ্ঠী:
- পূজার সূচনা হয় দেবীর বোধনের মাধ্যমে — “কেলি কাঞ্জক” স্থাপন ও আমন্ত্রণ মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে দেবীকে আহ্বান করা হয়।
- কলাবৌ স্থাপন ও দেবীকে স্নান করিয়ে পূজা মণ্ডপে অধিষ্ঠিত করা হয়।
🗓 সপ্তমী:
- সপ্তমীর সকালে হয় নবপত্রিকা স্নান ও প্রতিষ্ঠা। গঙ্গাজল ও মন্ত্রপাঠে গাছপালার রূপে দেবতাদের প্রতিস্থাপন করা হয়।
- এরপর হয় প্রথম পূজা, অঞ্জলি ও প্রসাদ বিতরণ।
🗓 অষ্টমী:
- দুর্গাপূজার অন্যতম পবিত্র দিন। দিনটি শুরু হয় মহাঅষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে।
- সন্ধ্যাবেলায় হয় সন্ধিপূজা, যা অষ্টমী ও নবমীর সংযোগক্ষণে সম্পন্ন হয় – এই সময় ১০৮ প্রদীপ প্রজ্বালন ও ১০৮ পদ্মফুলে পূজা হয়।
- সন্ধিপূজা উপলক্ষে ঢাক, কাঁসর, শঙ্খ ও ধুনুচির সুরে ভরে ওঠে রাজবাড়ি চত্বর।
🗓 নবমী:
- নবমীর সকালে হয় মহা নবমী পূজা, যা রামচন্দ্রের নবমী তিথিতে মহিষাসুর নিধনের স্মৃতিতে উদ্যাপন করা হয়।
- হয় বলি অনুষ্ঠান – প্রতীকী রক্তবিহীন বলি যেমন চাল, কুমড়া, উড়াদ ডাল ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।
- এই দিনেও সন্ধ্যায় আরতি ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়।
🗓 দশমী:
- দশমীর দিন হয় বিজয়া পূজা এবং দেবী বিসর্জন। দেবীকে সিঁদুর পরিয়ে, সিঁদুর খেলার মাধ্যমে বিদায় জানানো হয়।
- তারপর রাজবাড়ির উদ্যোগে শোভাযাত্রা সহকারে প্রতিমা বিসর্জন হয় স্থানীয় পুকুর বা নদীতে।
- বিসর্জনের পর অনুষ্ঠিত হয় বিজয়া শুভেচ্ছা বিনিময়, যেখানে ভক্তরা কোলাকুলি ও প্রণাম করে শুভেচ্ছা জানান।
এই পাঁচদিন মজিলা রাজবাড়ি পরিণত হয় এক উৎসবের কেন্দ্রস্থলে, যেখানে ধর্মীয় গাম্ভীর্যের পাশাপাশি উৎসবের আনন্দ, ভক্তি এবং ঐতিহ্য মিলেমিশে এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে।
বিশেষ আচার ও উৎসব: ধুনুচি নাচ, সন্ধিপূজা, সিঁদুর খেলা
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজার অন্যতম আকর্ষণ হলো এর বিশেষ আচার ও সাংস্কৃতিক উৎসব যা ভক্তদের মধ্যে এক অনন্য আবেগ ও উৎসাহ সৃষ্টি করে। এই পূজায় কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী আচার যথেষ্ট পরিচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ:
ধুনুচি নাচ
অষ্টমী ও নবমীর সন্ধ্যায় রাজবাড়ির চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় মনোমুগ্ধকর ধুনুচি নাচ। এতে বিশেষ দক্ষ পুরুষ ও মহিলারা হাতের ধুনুচিতে আগুন জ্বেলে ঢাকের তালে তালে নাচেন। এই নাচের মাধ্যমে দেবী দুর্গার প্রতি ভক্তি প্রকাশ করা হয়। ধুনুচি নাচের ছন্দ, ঢাকের গর্জন ও আগুনের আলো এক অপূর্ব উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করে।
সন্ধিপূজা
দুর্গাপূজার সবচেয়ে গম্ভীর ও পবিত্র সময় হলো সন্ধিপূজা। অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধ্যায় দশটি ‘সন্ধি’ বা সংযোগ মুহূর্তে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রপাঠ, প্রদীপ প্রজ্বলন ও অঞ্জলির মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে শাপগ্রস্থ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই পূজা করা হয়। মজিলা রাজবাড়িতে সন্ধিপূজার আয়োজন অত্যন্ত বিশাল ও পূর্ণ গৌরবে পালিত হয়।
সিঁদুর খেলা
বিজয়া দশমীর একটি জনপ্রিয় আচার হলো সিঁদুর খেলা, যা এখানে রাজপরিবারের ঐতিহ্যগতভাবে পালন করা হয়। সকাল থেকেই নারীরা সিঁদুর নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে একে অপরের গালে ও মাথায় সিঁদুর দেয়, যা দেবীর প্রতি ভক্তির প্রতীক। এই খেলা আনন্দ, সৌহার্দ্য এবং নারীর শক্তির সম্মিলন রূপে দেখা যায়। মজিলা রাজবাড়ির সিঁদুর খেলা স্থানীয় মানুষের মাঝে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এই বিশেষ আচার ও উৎসবগুলো মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজাকে কেবল ধর্মীয় আয়োজনে সীমাবদ্ধ না রেখে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনের উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
স্থানীয়দের অংশগ্রহণ: সমাজের ভূমিকা ও স্বেচ্ছাসেবক
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা শুধুমাত্র রাজপরিবারের নয়, বরং পুরো স্থানীয় সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ ও ঐক্যের ফল। এলাকার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৃত্তের ব্যক্তিরা সক্রিয়ভাবে এই পূজার আয়োজনে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
স্থানীয় শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, কৃষক, ও কারিগররা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে পূজার বিভিন্ন দিক যেমন মণ্ডপ সাজানো, প্রতিমা নির্মাণ, নিরাপত্তা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। এ ছাড়া পূজার সময় দর্শনার্থীদের সেবা, ভোজস্থানের আয়োজন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সফল পরিচালনায় স্থানীয় যুব সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
একটি সুগঠিত পূজা কমিটি স্থানীয় সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত, যারা বছরের পর বছর ধরে পূজার যাবতীয় পরিকল্পনা, বাজেট ও কার্যক্রম তদারকি করেন। তাদের প্রচেষ্টায় পূজাটি নির্বিঘ্নে ও শৃঙ্খলার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়।
স্বেচ্ছাসেবকরা রাতদিন পরিশ্রম করে পূজার সময় সকলের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু অনুষ্ঠান নিশ্চিত করেন। এছাড়াও, পূজার পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণ নিয়মিত আলোচনা সভা ও কর্মশালার আয়োজন করে থাকে।
এভাবেই মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা স্থানীয় মানুষের আত্মিক ও সামাজিক মিলনের এক শক্তিশালী মঞ্চ হয়ে ওঠে, যেখানে সবাই মিলেমিশে ঐতিহ্য রক্ষা ও উৎসব উপভোগ করেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: নাটক, পালাগান, মেলা, সংগীত
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজায় ধর্মীয় পূজা ছাড়াও যেটি সবচেয়ে বেশি মানুষকে আকর্ষণ করে তা হলো এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিবার পূজার সময় রাজবাড়ি চত্বর পরিণত হয় এক বিশাল সাংস্কৃতিক মঞ্চে, যেখানে ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও লোকজ সংস্কৃতি একত্রে প্রকাশ পায়।
নাটক ও যাত্রাপালা
পূজার বিভিন্ন দিনে স্থানীয় ও আমন্ত্রিত নাট্যদল পরিবেশন করে ধর্মীয় ও সামাজিক নাটক, যাত্রাপালা ও পল্লী-নাটক। রামায়ণ-মহাভারতভিত্তিক দৃশ্য, লোককাহিনি, বা সমসাময়িক সামাজিক বার্তাবাহী নাটক এখানে দর্শকদের মন জয় করে নেয়।
পালাগান ও বাউল সঙ্গীত
প্রাচীন লোকসংস্কৃতির ধারায় মজিলা দুর্গাপূজায় নিয়মিত আয়োজন হয় পালাগান, কবিগান ও বাউল গানের। একতারা, দোতারা ও খোলের তালে তালে এসব পরিবেশনা পূজার রাতগুলোকে জীবন্ত করে তোলে।
মেলা ও হস্তশিল্প প্রদর্শনী
রাজবাড়ির চারপাশে বসে স্থানীয় মেলা, যেখানে গ্রামীণ হস্তশিল্প, খাদ্যপণ্য, খেলনা ও সাজসজ্জার সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশু-কিশোরদের জন্য থাকে নাগরদোলা, বেলুন ও ছোটখাটো খেলাধুলার আয়োজন।
সংগীত ও নৃত্য অনুষ্ঠান
স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আয়োজন করে ভক্তিগীতি, আধুনিক গান, নৃত্য ও কবিতা পাঠ। এতে অংশ নেয় শিশুরা, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে প্রবীণ শিল্পীরাও। বিশেষ করে দশমীর আগের রাতের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা থাকে দর্শকপূর্ণ।
এইসব অনুষ্ঠান কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং সাংস্কৃতিক চর্চা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যম হিসেবেও গুরুত্ব বহন করে। মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা তাই কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ লোকজ উৎসব।
আরও পড়ুন: সুগন্ধা শক্তিপীঠের পৌরাণিক ইতিহাস ও ভক্তদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা
পর্যটকদের আকর্ষণ: দর্শনার্থী, সামাজিক প্রভাব, মিডিয়া কাভারেজ
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা শুধু স্থানীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—প্রতি বছর এখানে দূর-দূরান্ত থেকে আগত হাজার হাজার দর্শনার্থী ও পর্যটক এসে ভিড় জমান। রাজবাড়ির ইতিহাস, পূজার আচার-আনুষ্ঠানিকতা, এবং ঐতিহ্যবাহী পরিবেশের কারণে এটি ধীরে ধীরে এক জনপ্রিয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গন্তব্য হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
দুর্গাপূজার সময় মজিলা গ্রাম যেন হয়ে ওঠে এক সজীব উৎসবনগরী। মানুষ আসে রাজশাহী শহর, নাটোর, পাবনা, এমনকি ঢাকা বা পশ্চিমবঙ্গ থেকেও। অনেকে শুধুমাত্র প্রাচীন রাজবাড়ির পূজা দেখার উদ্দেশ্যেই পরিবারসহ সফর করেন। পর্যটকদের জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও তৈরি করেন অস্থায়ী দোকান, খাবারের স্টল এবং হস্তশিল্পের প্রদর্শনী।
এছাড়া, পূজার সময়ে মিডিয়ার উপস্থিতিও লক্ষণীয়। স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদমাধ্যম, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই পূজার ছবি, ভিডিও ও প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। অনেক ব্লগার ও ইউটিউবার এই পূজা কাভার করে থাকেন, যার ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়।
এই দুর্গাপূজা শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও পর্যটন সম্পদ হিসেবেও বিবেচিত। ফলে এর মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিও সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং গ্রামীণ উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়।
বর্তমান পূজার রূপ: আধুনিকত্ব, কমিটি, ডিজিটাল প্রচার
সময় বদলেছে, বদলেছে সমাজের রূপ ও আয়োজনের ধারা। তবে মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা আজও তার মূল ঐতিহ্য ও ধর্মীয় গাম্ভীর্য বজায় রেখেছে, পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়াও।
বর্তমানে এই পূজার পরিচালনায় রয়েছে একটি সক্রিয় স্থানীয় পূজা উদ্যাপন কমিটি, যেটি রাজপরিবারের অনুপস্থিতিতেও পূজার দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করছে। পূজার আয়োজন, অর্থব্যবস্থা, নিরাপত্তা, ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম—সব কিছুই হয় পরিকল্পিতভাবে।
পূজামণ্ডপে এখন রয়েছে আলো-সজ্জার আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন রঙিন LED আলো, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদি। প্রতিমার সাজসজ্জায় এসেছে নতুনত্ব, কিন্তু শিল্পশৈলীর মূল ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রয়েছে।
ডিজিটাল যুগে, মজিলা রাজবাড়ির পূজাও পিছিয়ে নেই। স্থানীয় তরুণদের উদ্যোগে এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে লাইভ স্ট্রিমিং, ফেসবুক পেজ, ইউটিউব ভিডিও ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পূজার খবর প্রচার করা হয়। এতে দূরে থাকা প্রবাসী ভক্তরাও পূজার আনন্দে অংশ নিতে পারেন ভার্চুয়াল মাধ্যমে।
এছাড়া, পরিবেশ সচেতনতা, নারী-পুরুষ সমান অংশগ্রহণ, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ—এসব ক্ষেত্রেও বর্তমান পূজার রূপ প্রশংসাযোগ্য। সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে এখন পূজা হয়ে উঠেছে একটি সমাজের মিলনমেলা ও আত্মিক চেতনার কেন্দ্রবিন্দু।
সুরক্ষা ও পরিবেশ বিষয়ক উদ্যোগ: নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পরিবেশ সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজায় প্রতিবছর হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে। এই ভিড় সামলাতে ও উৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে স্থানীয় পূজা কমিটি ও প্রশাসনের উদ্যোগে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক দল মোতায়েন থাকে মণ্ডপ এলাকায়, থাকছে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ও পর্যবেক্ষণ টিম।
নিরাপত্তার পাশাপাশি বর্তমান সময়ে অন্যতম গুরুত্ব পাচ্ছে পরিবেশ সচেতনতা। প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, প্রতিমা তৈরিতে পরিবেশবান্ধব মাটি ও প্রাকৃতিক রং ব্যবহারের প্রতি জোর দেওয়া হয়। বিসর্জনের সময় দূষণমুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে জলাশয়ে প্রতিমা নিরসন করা হয়।
স্বাস্থ্যবিধির বিষয়েও দেখা যাচ্ছে আধুনিক সচেতনতা। করোনা-পরবর্তী সময়ে মণ্ডপে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক বিতরণ, এবং চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এছাড়াও, মণ্ডপ এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়।
সব মিলিয়ে মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা এখন শুধুই ধর্মীয় আচার নয়—বরং এটি একটি নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত উৎসব হিসেবে গড়ে উঠেছে, যা স্থানীয় ও বহিরাগত সকল দর্শনার্থীদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিলনক্ষেত্র
মজিলা রাজবাড়ির দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য, যেখানে অতীতের গৌরব ও বর্তমানের গতিশীলতা একসঙ্গে মিশে আছে। রাজপরিবারের ঐতিহাসিক প্রভা, প্রতিমা নির্মাণের নিপুণতা, ধুনুচি নাচের আবেগ এবং আজকের প্রযুক্তিনির্ভর আয়োজন—সব মিলিয়ে এটি এক গভীর সাংস্কৃতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
এই পূজা বছরের পর বছর ধরে মানুষের মাঝে ভক্তি, ঐক্য, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, পরিবেশ সচেতনতা, এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার সংযোজন এই পূজাকে করেছে আরও সমৃদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য।
ভবিষ্যতেও এই পূজা যেন তার ঐতিহ্য বজায় রেখে নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করে এবং বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকে—এই হোক আমাদের কামনা।
আরও পড়ুন: শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা, কলকাতার ঐতিহাসিক পূজোর পূর্ণ বিবরণ